যমুনা পাড়ের শহরতলী- গোবরডাঙা
- Shrabanti Mitra
- Jun 28, 2022
- 9 min read
Updated: Jul 14, 2022

সমগ্র বঙ্গদেশকে যদি একটি বৃহত্তর যৌথ পরিবার হিসেবে কল্পনা করা হয়, তবে সে পরিবারের ভাই বোনেদের নদ-নদী রূপে আখ্যা দিলে অত্যুক্তি হবে না একেবারেই। আমাদের দেশ ভাগ হয়েছে। সে ভাগে আলটপকা ঢিল মেরে কিছু অংশ মিশে গেছে এদিকে, আর কিছু ওদিকে। তবে মূল সুতোর টান এখনো রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাড়া দিয়ে যায় প্রতিটি অঞ্চলের মাটিতেই।
আমরা অনেকেই জানি এপার বাংলার উত্তর ২৪ পরগনার বহু অঞ্চল একসময় পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখনো এই প্রান্তের শেষ সীমানা পেরিয়েই বাংলাদেশের কাঁটাতার টপকান বহু মানুষজন। বাংলার এপারে যেমন গঙ্গা বড় দিদির মতো সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেছে পূর্ব দিকে, তেমনই পশ্চিমে নদীয়া জেলার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেছে যমুনা নদী ইচ্ছামতীকে সঙ্গে নিয়ে। যমুনা যদি নদী হয়, ইচ্ছামতী তবে উপনদী। আর এই দুই নদী উপনদীর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুশদহ পরগণার অন্তর্গত অতি প্রাচীন অঞ্চল গোবরডাঙা। এই গোবরডাঙারই দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যেমন বয়ে গেছে যমুনা নদী, তেমনই উত্তর দিকে মিলিত হয়েছে ইচ্ছাপুরের খালের সঙ্গে, আর পূর্বে বাঁক নিয়ে সৃষ্টি করেছে বিশাল এক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ।

অনেককেই বলতে শুনেছি গোবরডাঙায় কি আগে গোবর ছিল? তবে সত্যি বলতে কি কখনো কোনো প্রবীণব্যক্তির মুখেও গোবরডাঙার গোবরের প্রসঙ্গ উঠতে দেখিনি। বরং দেখেছি এই অঞ্চলের লাল চিনির ব্যবসা সম্পর্কে কথা বলতে। কুশদ্বীপের অন্তর্গত এই অঞ্চলে একসময় নদীর ধার জুড়ে ছিল প্রচুর চিনির কল। এখানকার তৈরী আখের লাল চিনি রফতানি হতো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সঙ্গে ছিল খাটুরায় লবণ কারখানা এবং চলতো একই সঙ্গে বাংলার চিরাচরিত নীল চাষ, যার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় গোবরডাঙার আনাচে কানাচে পড়ে থাকা নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ থেকে।

আঠেরোশো শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন বর্গী আক্রমণের ফলে বাংলার বহু মানুষ ঠাঁই নাড়া হয়েছিলেন পূর্ব থেকে পশ্চিমে, তাঁদের মধ্যে হুগলীর সপ্তগ্রামের ৪২ ঘর তাম্বুলি বণিক (রক্ষিত, সেন, আশ, কোঁচ, দত্ত, কর, দে, পাল, কুণ্ড) বসবাস করা শুরু করেন এই খাঁটুরায়। এই কুশদহ পরগনারই মাটিকোমরা, গৈপুর, খাঁটুরা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই সূত্রেই ছড়িয়ে পড়েন ‘নবন্যায়’ শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ সংস্কৃত পণ্ডিতেরা।

ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রাচীন যে কোনো জনপদেই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের হদিশ পাওয়া অবশ্যম্ভাবী। তেমনভাবে এখানেও ১৮৫০-৮০ সাল নাগাদ কানাই-নাট্যশালা গ্রামে মাটি খুঁড়তে গিয়ে একাধিক প্রাচীন মন্দিরের ভিত পাওয়া যায়। এছাড়াও এখানকার মাটকুমড়ো অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে বহু পুরানো ইঁটের স্তুপ সহ রীতিমতো আস্ত ঘরবাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে।

তবে গোবরডাঙা যে যে কারণে ইতিহাসের পাতায় নাম রেখেছে, তার একটি অন্যতম কারণ হলো এই অঞ্চলের ইতিহাসসমৃদ্ধ সংস্কৃতি, যার অবদান রেখে গেছেন বাংলার নবজাগরণের প্রথিতযশা সন্তানেরা। এঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর কথা বলব তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম বিধবা বিবাহের সমর্থক পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। খাঁটুরার বাসিন্দা শ্রীশচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহযোগী থাকাকালীন ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হবার পর ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে বর্ধমানের বাল্য বিধবা কালীমতীকে বিয়ে করেন। ১৮৭০ সালে গোবরডাঙা পুরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হন শ্রীশচন্দ্রই। এর পরবর্তী সময়ে বনগাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে যুক্ত হবার পর, বনগাঁ-শিয়ালদহ ট্রেনলাইন তৈরির ব্যাপারেও তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোগী ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, ১৮৮৩ সালে দমদম থেকে দত্তপুকুরের রেলপথ তৈরির সময়ে তিনি গোবরডাঙা পর্যন্ত রেল পথটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচিও নিয়েছিলেন। আবার সেকালের কষ্টসাধ্য জলপথে যাতায়াতের সমস্যা দূর করতে তিনি সড়কপথে গোবরডাঙা-ইছাপুরের মধ্যে রাস্তাটি নির্মাণেও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। শ্রীশচন্দ্র ছাড়াও গোবরডাঙা অঞ্চলে ছিল বহু পণ্ডিতের বাস। এই অঞ্চলেরই কৃতি ব্যক্তিত্ব প্রমথনাথ বসু ছিলেন জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং ময়ূরভঞ্জ লৌহ খনির আবিষ্কারক। তাঁর নামেই তৈরি হয়েছে ‘প্রমথনাথ বসু স্মৃতি গোরবডাঙা পৌর টাউন হল।’

কেবল ইতিহাস এবং সংস্কারে নয়, গোবরডাঙা শিল্পচর্চাতেও বরাবরই অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে।
এখানকার নাট্যচর্চার ইতিহাস প্রায় ১৫০ বছর আগেকার। দেশের বহু প্রান্তে এখানকার নাট্যদলগুলির নাটক যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনই থিয়েটারকর্মীরাও বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন মঞ্চে। এই চর্চাকে উৎসাহিত করতে সম্প্রতি এখানে তৈরি করা হয়েছে "শিল্পায়ন নাট্য বিদ্যালয়"। এসব কারণেই গোবরডাঙার আরেক নাম "ভিলেজ অব থিয়েটার"ও বটে।
এবার আসি গোবরডাঙার দ্রষ্টব্য স্থানগুলির বিষয়ে। এমন স্বনামধন্য অঞ্চল, অথচ জমিদার বাড়ি থাকবে না তা কি হয়! ফলত, গোবরডাঙা নিয়ে এতোক্ষণ যা যা বললাম, তার সঙ্গে প্রধান এবং অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে জুড়ে দেবো গোবরডাঙা জমিদার বাড়িকে।

গোবরডাঙা জমিদার বাড়ি
শহরের প্রাণকেন্দ্রে ফাঁকা জমির মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই জমিদার বাড়ি। একখানা পেল্লায় প্রাসাদ বটে! বাড়িখানা দেখে কোনোভাবে বোঝার উপায় নেই এর প্রাচীনত্ব। সমগ্র বাড়ির কোনো অংশে একটুও মলিনতার চিহ্ন নেই। আর হবে নাই বা কেন? এই বাড়িটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে এ বাড়ির বাবুমশাইদের পাশাপাশি সাহেববাবুদেরও যথেষ্ট অবদান ছিল।

কথায় বলে, টাকির জমিদারের লাঠি আর গোবরডাঙার জমিদারের হাতি। হ্যাঁ, গোবরডাঙার জমিদারদের হাতি পোষার মতোন এলেম ছিল বটে। সে হাতির সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে গোবরডাঙা সাড়ে তিন নম্বর(৩.৫) প্ল্যাটফর্ম, যে প্ল্যাটফর্মের রাস্তা দিয়েই সেকালে হাতি উঠে যেত ট্রেনে। শুনে অবাক হবার কিছু নেই। জমিদারের হাতি ট্রেনে উঠতেই পারে। তবে শুধু ট্রেনেই উঠতো না সঙ্গে যেত যশোর এবং অন্যান্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে।

এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষরা ছিলেন যশোরের বাসিন্দা এবং সেখানে থাকাকালীনই এই বংশের আদিপুরুষ রামরাম মুখোপাধ্যায় দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে পরিবারের বংশধররা গোবরডাঙায় এসে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন। এই পরিবারের শ্যামরাম মুখোপাধ্যায় ছিলেন গোবরডাঙার ইছাপুরের চৌধুরী বাড়ির জামাই, যাঁর পুত্র খেলারাম মুখোপাধ্যায়ের বহুবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই এই জমিদার পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। তিনিই তাঁর মামাবাড়ীতে যশোরের পর এখানে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন।

ঠাকুরদালান
এই খেলারামই ছিলেন ইংরেজ শাসনকালে ২৪ পরগনার ম্যাজিস্ট্রেটর তদারক। তাঁর নিখুঁত দক্ষতায় প্রশংসিত হয়ে সাহেববাবু তাঁকে দান করেন বেশ কিছু জমিজমা, যেখানে ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তোলেন তাঁর স্বপ্নের প্রাসাদ। তবে খেলারামবাবু নির্মিত আদি বাড়িটির আজ আর অস্তিত্ব নেই। এখন যে বাড়িটিকে আমরা জমিদার বাড়ি হিসেবে জানি সেটি আসলে ইংরেজদের তৈরি করা এ বাড়ির অতিথিশালা ‘ফেয়ারি হল’, যেটির ব্যবহার শুরু হয় ১৯১৪ সাল থেকে।

অন্দরমহলের উঁকি দিয়ে যে সব আন্টিক সামগ্রী চোখে দেখা গেলো

পরবর্তীকালে জমিবাড়ি ভাগাভাগির সময় এ বাড়ির বড় তরফের সন্তান গিরিজাপ্রসন্ন মুখোপাধায়ের ভাগে পড়ে এই অংশটি, তখন থেকেই বসবাস করা শুরু করেন তাঁর বংশধরেরা এখানে। এই গিরিজাপ্রসন্নের একটি বিশেষ অবদান হল এই পরিবারে 'সেটেলমেন্ট’ প্রথা চালু করা, যে কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে পঞ্চম জর্জ তাঁকে ‘রাজা’ খেতাব দিতে চান। কিন্তু তিনি ততোদিনে 'রায়বাহাদুর' খেতাবে গৌরবান্বিত হয়ে গেছেন আগেই, তাই নতুন করে আর রাজাধিরাজ সম্মানে আত্মগৌরব বাড়াতে চাননি। তবে রাজার উপহার কি ফেরানো যায়? তাই পরবর্তীকালে তিনি ভেবেচিন্তে রাজা সম্মানের পরিবর্তে ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে অনুগ্রহপূর্বক চেয়ে নেন একটি ঐতিহাসিক তরবারি, যা আসল তরবারিটির হুবহু আদলে সম পরিমাণ সোনায় মুড়ে উপহার দেওয়া হয় গিরিজাপ্রসন্নকে।

দোতলায় ওঠার সময়

এই বাড়িটি স্থাপত্যগুণে যেমন অনন্য, তেমনই ঐতিহ্যেও। একসময় মার্গসঙ্গীতের আসর বসত এ বাড়ির জলসাঘরে। দেশের ও বিদেশের বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা এখানে এসে অনুষ্ঠান করে গেছেন। এখনো এ বাড়ির অন্দমহলে ছড়িয়ে আছে বহু দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য সামগ্রী।


ভিন্টেজ যারে কয়, ডানদিকে পঞ্চম জর্জের সাথে সাক্ষাতের ঐতিহাসিক দলিল

বিদেশে নয় খোদ কলকাতায় বানানো ল্যাজারাস অ্যান্ড কোং এর তৈরী
সাধারণত এ বাড়িতে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় না দুর্গাপুজো ব্যতীত। তবে পূর্ব অনুমতি নিয়ে এলে কিছুক্ষণের জন্য দেখার সুযোগ মিলতে পারে জমিদারবাড়ির চৌহদ্দি।

প্রসন্নময়ী কালীমন্দির
রাজবাড়ি থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে বহু ইতিহাস জর্জরিত প্রসন্নময়ী কালীবাড়ি।
আগেই বলেছি এই পরিবারের খেলারাম মুখোপাধ্যায়ের কথা। তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী বহুদিন ধরে নিঃসন্তান থাকার সময় একদিন তিনি দক্ষিণাকালীকে আরাধনা করার স্বপ্নাদেশ পান। ফলে বেনারস থেকে কারিগর আনিয়ে তিনি রাতারাতি শুরু করেন কালী মন্দির স্থাপনের কাজ। এর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর স্ত্রী জন্ম দেন এক পুত্রসন্তানের। খেলারাম বাবু পুত্রের নাম দেন 'কালীপ্রসন্ন'। সেই থেকেই এই পরিবারের প্রতিটি সন্তানের নামের পাশে 'প্রসন্ন' শব্দটি ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত খেলারামবাবু শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করে যেতে পারেন না মন্দির নির্মাণের কাজ। তাই এরপর সে দায়িত্ব আসে তাঁর নবীন পুত্র কালীপ্রসন্নের কাছে। কালীপ্রসন্ন সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন বাংলার ১২২৯ সালের পয়লা বৈশাখ। সে কারণেই এই মন্দিরের নামকরণ করা হয় "প্রসন্নময়ী কালীবাড়ি"।

উচ্চ বেদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণমুখী এই মন্দিরের দু'পাশে রয়েছে ৬টি করে মোট ১২টি শিবমন্দির। কালো প্যাঁচানো কাঠের সিংহাসনবেষ্টিত দেবীর পদতলে শায়িত আছেন শ্বেতপাথরের মহাদেব। প্রতিবছর কালীপুজোর আগে নিয়ম করে তিনটি পাঠা বলি দেওয়া হলেও, ১৯৯৭ সালের পর থেকে সেসব বন্ধ। এখন কেবল চিনি আর মধুতেই নিবেদিত হন মা। একসময় মা'কে সাজাতে বহু সোনা, রুপো, হীরে ও পান্নার গহনার ব্যবহার করা হলেও, এখন সেসবের কিছুই প্রায় হয় না। তবে সোনা-রুপোর অলংকারে এখনো ভূষিতা হন দেবী। এছাড়া একসময় পর্যন্ত বাড়ির মেয়েদের বিয়েতে গয়না বানানোর সময় মায়ের জন্যও বানানো হতো নতুন অলংকার। এখনো পুজোর দিনে এখানে ৫০০ জনের বেশী মানুষের জন্য ভোগের ব্যবস্থা করা হয়।

একবার জলপথে বেড়াতে বেড়াতে রানী রাসমণি আসেন এই প্রসন্নময়ী মা'কে দেখতে। মন্দির দর্শনের মুগ্ধতার রেশ রাখতে স্মৃতির স্মারক হিসেবে পুঁতে যান একটি বটবৃক্ষের চারা মন্দির প্রাঙ্গণে। আজও কেউ মন্দির দর্শন গেলে দেখতে পাবেন সেই অক্ষত বটগাছটিকে।
রানী রাসমণি আর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের পরমারাধ্য এই স্থানে একসময় প্রতি নববর্ষের দিনে পালন হতো "গোষ্ঠ উৎসব"। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে চারদিক ঘিরে ফেলে মন্দির চত্বরে ছেড়ে দেওয়া হতো একটি গাভী ও একটি শুকর ছানাকে এবং ক্রমাগত উৎসাহিত করা হতো উভয়কেই যুদ্ধরত হবার জন্য। এভাবে চলতে চলতে যতক্ষণ না গাভীটি শূকরটিকে পরাজয় করতে পারছে, ততক্ষণ এই খেলা জারি থাকতো। বর্তমানে খেলাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পশু সুরক্ষার কারণে।

আদি জমিদার বাড়ি ছিল এখানেই
কালীবাড়ি থেকে একটু এগিয়েই চোখে পড়বে একটি সিংহদুয়ার। দুয়ার যদিও এখন আর নেই, কেবল পড়ে রয়েছে দুটি প্রাচীন থাম। তবে এই থামযুগলের অভ্যন্তরেই ছিল গোবরডাঙার আদি জমিদার বাড়ির অস্তিত্ব, যা লোকমুখে মেজোবাবুর বাড়ির নামে পরিচিত।

মশলা মেলা
আজ এই অঞ্চল জুড়ে চলে বিকিকিনির হাট, যাকে আমরা জানি 'মশলা মেলা' নামে। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন থেকে টানা ১০ দিন অবধি চলে এই মেলা। মূলত কৃষকদের উৎপাদিত মশলা খোলা হতে বিক্রি করে যে লভ্যাংশ উঠবে, তা দিয়ে রাজঋণ মিটিয়ে কৃষকদের ফেরৎ পাঠাবার পরিকল্পনা থেকেই এই মেলা শুরু করেন খেলারাম মুখোপাধ্যায়। এই মেলার একটা চমকপ্রদ বিষয় এই যে এখনো এই মেশিনের যুগে দাঁড়িয়েও এখানে যে সমস্ত মশলা প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ীরা আসেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, তাঁদের সবার কাছেই থাকে হাতে তৈরী সামগ্রী। যে কারণে বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে এসে ব্যাগ ভর্তি করে মশলা নিয়ে যান, কেবলমাত্র হাতে বানানো মশলার স্বাদ পেতে।

সূর্যঘড়ি
যে জায়গায় এই মেলা আয়োজন করা হয় তার প্রবেশপথের সামনেই রয়েছে একটি সূর্যঘড়ি, যা আজ অবহেলায় পড়ে। অনেকে হয়তো লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু জানেন না বিষয়টি কি!
সূর্যঘড়ি হল এমন একটি কৌশল যা সূর্যালোককে কাজে লাগিয়ে সূর্যের অবস্থান নির্ণয়ের মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করা হয়। ব্রিটিশরাজের আমলে ঘড়ির ব্যবহারের তেমন প্রচলন ছিলোনা মফস্বলে। সেই কারণেই সাধারণ মানুষের দিনযাপনে, সময়ের হিসেব রাখার সুবিদার্থে ১৮৬৮ সালে জমিদার সারদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় এই সূর্যঘড়িটি বানানোর পরিকল্পনা করেন, যার নির্মাণকাজে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন তৎকালীন শিক্ষা সচিব ও গণিত বিশারদ হলিডে সাহেব। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তেই আমরা সূর্যঘড়ি দেখে থাকি, যেমন হুগলীর ইমামবাড়া, তবে গোবরডাঙার এই সূর্যঘড়িটি আকারে এবং আয়তনে অন্যগুলোর থেকে বেশ অনেকটাই বড়।

বর্তমানে সূর্যঘড়িটি তার কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝাও যাবে না, এটির আলাদা কোনো ভূমিকা আছে। সম্প্রতি পৌরসভার তরফ থেকে এটির ওপর নতুন রঙের প্রলেপ পড়লেও, এখন এটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ ছাড়া আর কিছুই না।

মুখার্জী ভিলা
এবার বলি এই মুখোপাধ্যায় পরিবারেরই আরেকটি জায়গার কথা, যেটি একসময় মূল জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন শরিকি বিভাজনে বিযুক্ত হয়ে গেছে। ভেতরের ছিমছাম নিরিবিলি পরিবেশ, সাথে ফোয়ারা এবং পরীর উপস্থিতি বাড়িটাকে একটা অন্যরকম পরিমণ্ডল দিয়েছে। যদিও শুনলাম এখানে পরিবারের লোকজন এসে থাকেন, তবে তার দৈনন্দিন ছাপ স্পষ্টত পাওয়া গেলো না।

গোবরডাঙার পাশের গ্রাম ইছাপুর। এই ইছাপুরের বাজার অঞ্চল মল্লিকপুর পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক এগোলেই চোখে পড়বে অপূর্ব টেরাকোটার কারুকাজ সম্বলিত শ্রীগোবিন্দ মন্দির, গোবরডাঙা অঞ্চলে যেটি দোলখোলা মন্দির নামেও পরিচিত।

গোবিন্দ মন্দির
আগেই বলেছি গোবরডাঙার সংলগ্ন অঞ্চলে ছিল পণ্ডিতদের বাস। তেমনই জনৈক এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রাঘব সিদ্ধান্তবাগীশ পঞ্চোদশ শতকের শেষভাগে তৎকালীন কুশদ্বীপ (বর্তমানের ইছাপুর) অঞ্চলে জমিদারির গোড়াপত্তন করেন। বিস্তৃত যমুনা নদী এবং চালুন্দিয়া নদীর মধ্যবর্তী এই জনপদ তখন ছিল মোঘল সম্রাট আকবরের অধীনে। রাঘব পণ্ডিত ১৫৮০-৮৩ সাল নাগাদ সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করার ফলস্বরূপ আকবর তাঁকে রাজানুকুল্যে ‘চৌধুরী’ উপাধি দেন। তাঁর পৌত্র রঘুনাথ ১৬৫১ সাল নাগাদ এই নবরত্ন গোবিন্দ জীউর মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

ধীরে ধীরে কালক্রমে পুরোনো মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে যাবার ফলে এর পাশের জমিতে আরেকটি নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়, সঙ্গে তৈরি করা হয় দোলমঞ্চও। সেখানে পুরোনো মন্দির থেকে প্রতিষ্ঠাফলক সহ ভগ্নপ্রায় হয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি টেরাকোটা প্যানেলের অংশ খুলে নিয়ে সংযোজন করা হয় নতুন মন্দিরে।

দোল উৎসবের সময় এখানে গোবিন্দ জিউর বিগ্রহটিকে দোলমঞ্চে এনে আবির সহযোগে আরাধনা করা হয় এখনো, সাথে চারদিন ধরে চলে মেলা মন্দিরের মাঠ জুড়ে।

গোবিন্দজিউর বিগ্রহ
নতুন মন্দিরটি দেখতে সুসজ্জিত হলেও সমস্ত স্থাপত্যগুণ পুরোনো মন্দিরেই রয়েছে। এই মন্দিরটির চৌহদ্দি জুড়ে আগাছারা সংসার পাতলেও এখনো বেশ কিছু পোড়া মাটির কাজ অক্ষুণ্ণ রয়েছে এখানে।

২০০৮ সালে মন্দিরটি "ASI Kolkata Circle " থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন থেকে মন্দিরটিকে "হেরিটেজ" তকমা দেওয়া হয়। তবে তকমার পরিবর্তে মন্দিরটির সংস্কারের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত।

জোড়া শিব মন্দির
এবার আসি ঘাটের কথায়। ঘাট বলতে অশ্বক্ষুরাকৃতি এক হৃদের কাছে যাবার ঘাট। এই ঘাটের পাড়েই চণ্ডীতলায় ১৮৬৮ সাল নাগাদ মায়ের স্মৃতিতে জোড়া শিবমন্দির স্থাপন করেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। এই ঘাটের পড়েই একসময় শ্রীশচন্দ্রের বসতবাড়িটিও ছিল। আজ সে বাড়ির অস্তিত্ব না থাকলেও, জোড়া শিবমন্দির এবং ঘাটটি জ্বলজ্বল করছে আগের মতোই।

নদী দিয়ে শুরু করেছি যেমন, নদী দিয়েই শেষ করবো আবার। যে পথেই যাই নদী বয়ে যায়, দিনের শেষে তাই আমাদের সকলকেই নদীর কাছাকাছি ফিরতে হয়। তবে এ নদী দু'পার বিস্তৃত চেনা দৃশ্যাবলি দেয় না আমাদের, বরং নিয়ে যায় বিভূতিভূষণ চর্চিত এক অরণ্যময় বাওরের কাছে, যাকে আমরা কেউ কেউ বলি বেড়ির বাওর, আবার কেউ বলি কঙ্কনের বাওর। তবে এ দু'টি শব্দবন্ধের অর্থ ভিন্ন।

বেড়ির বাওর
ইচ্ছামতীর খাল যে জায়গা থেকে আরো পশ্চিমে বাঁক নিয়ে এগিয়ে গেছে, সে জায়গাটাকে বলা হয় বেড়ির বাওর। আবার এই অঞ্চলের স্থানীয় খরস্রোতা নদী চান্দুলিয়ার যে অংশটি খাঁটুরা অঞ্চলের পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তাকে বলা হয় ‘কঙ্কনা বাওর’।
শোনা যায়, এই সবুজে ঘেরা কঙ্কনা বাওরের একপ্রান্তে থাকতেন দেবী চণ্ডী, আর ওপর প্রান্তে থাকতেন তাঁর বোন শীতলা। বোনের বাড়ি যাওয়ার পথে কোনও একদিন দেবী চণ্ডীর কঙ্কন এখানে পড়ে যাওয়ার পর থেকে এই জলাশয়ের নামকরণ করা হয় 'কঙ্কন'। আর বাওর কারণ যেহেতু এটি চালুন্দিয়া নদীর অংশ থেকে বাঁক নিয়ে পরিণত হয় অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে। তাছাড়া জলাশয়টির আকৃতিও অনেকটা কঙ্কন বা কাঁকনের মতোই প্রায় গোলাকার। তবে যদি পূরণ মতানুসারে বলতে হয়, তবে বলবো ঘাটের দুপারে চণ্ডী এবং শীতলা উভয়েরই মন্দির আজও আছে এখানে।

কঙ্কনা বাওরে বৈকালিক নৌ চলাচল
বিকেলের দিকে এখানে এলে মাঝিদের বললে নৌকা চড়ে বাওরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছোনো যায় জলপথে। এই কঙ্কনের জলাশয় আগের মতো জঙ্গলাকীর্ণ না হলেও বাংলাদেশ বর্ডারের কাছাকাছি থাকা এই অঞ্চলে এখনো গভীর অরণ্যের হাতছানি টের পাওয়া যায় কিছুক্ষণ থাকলেই। সব নদীর জল যেমন সমান স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো, তেমন কঙ্কনে গেলেও কখনোই টের পাওয়া যায় না কোন নদীর জল কোন দিক থেকে এসে মিশেছে।

এতোক্ষণ সবই বলেছি কেবল বলিনি 'গোবরডাঙা' নামটা কোথা থেকে এলো। শুরুতে বললে কিঞ্চিৎ ভ্রুকুঞ্চিত হবার সম্ভাবনা থাকতো পাঠকগণের। তাই শেষে এসে বলে দিলাম। গোবরডাঙা আদতে একটি সংস্কৃত শব্দের অপভ্রংশ, যেখানে ‘গো’ বলতে পৃথিবী, ‘বর’ বলতে শ্রেষ্ঠ এবং ‘ ডাঙা’ বলতে স্থান বোঝায়, অর্থাৎ সব মিলিয়ে হলো গিয়ে ”পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান”। এবার উপরিউক্ত তথ্যাবলী ঝাড়াই-বাছাই করে গুরুত্ব বিশ্লেষণ করার পর গোবরডাঙ্গাকে "পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থল" নামে আখ্যা দিতে কারোর আপত্তি আছে কি?

এখনো ঘটকা লাগছে? বিষয়াদি যাচাই করতে ঘুরেই আসুন না একদিন সকাল সকাল বনগাঁ লোকালে চেপে গোবরডাঙা থেকে। তবে যাবার আগে যে যে জরুরি বিষয়গুলো মনে রাখবেন সেগুলো হলো-
শিয়ালদহ থেকে বনগাঁগামী যে কোনো ট্রেনে উঠে গোবরডাঙা স্টেশনে নামবেন। ট্রেন কিন্তু একটু পরে পরেই। তাই একটা মিস করলে হাঁ করে বসে থাকা ছাড়া অন্য উপায় এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না।
গোবরডাঙা জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবেন দুর্গাপুজোর সময় একমাত্র। অন্য সময়ে গিয়ে পূর্ব অনুমতি ছাড়া ঢোকার প্রত্যাশা না করাই ভালো। কপাল ভালো থাকলে আলাদা ব্যাপার।
প্রসন্নময়ী কালীমন্দির দুপুর ১টা অবধি খোলা থাকে। ফলে পুজো দিতে চাইলে আগে আগে চলে যাওয়াই ভালো।
গোবিন্দমন্দির মোটামুটি দুপুর ১টা ১:৩০ টা অবধি খোলা থাকে।
বেড়ির বাওরে গেলে চেষ্টা করবেন সূর্যাস্ত দেখার এবং দিনের আলো থাকতে থাকতে জলপথে ভ্রমণ সেরে ফিরে আসবেন অবশ্যই।
এমনিতে আশেপাশে খুব তেমন কিছু খাবার দোকান নেই গোবরডাঙা স্টেশন এলাকা এবং মন্দির চত্বর ছাড়া। ফলে সঙ্গে শুকনো খাবার রাখবেন।

Comments