top of page

স্মৃতির শহর

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Apr 26, 2020
  • 4 min read

Updated: Jul 25, 2020


আজকের ডালহৌসি চত্বর

আমার স্মৃতির শহর কলকাতা। প্রতিদিনের সুখদুঃখ হাসি কান্না রাগ অভিমানে ভরা, একটা প্রানবন্ত জীবন আছে এই শহরের। সুতানটি আর গোবিন্দপুরের একটা গোটা জঙ্গল কেটে সাহেবি কায়দায় প্রাসাদনগরীর উত্তরণ থেকে শুরু করে, আজকের মেট্রো সিটির বিয়াল্লিশ তলা উঁচু বাড়ির নিজের পায়ে দাঁড়াবার পিছনে কত ধাক্কা, কত লড়াই, কত রক্ত, কত রঙ, কত শরীর, কত ঢং!

তাই অনেকের মত আমারও মনে হয় কলকাতার একটা হৃদয় আছে, যার হৃদস্পন্দন রাতের অন্ধকারে ট্রামলাইনের ওপর কান পাতলে, এখনো পাওয়া যায়। তিনশো বছরেরও বেশী এই শতাব্দী প্রাচীন শহরে, কম মানুষ তো আসেনি, ঠাঁই নিতে! তবু এ শহর ফেরায় না কাউকে। যতটুকু ছায়া আছে, তার এই বিশাল বটগাছটার তলায়, তার মাঝেই ছোট ছোট বাসায় আগলে রাখতে চায় সকলকে। সেই কবে কোন যুগে এর ওর হাত ঘুরে, নিজের অধিকারটাকে একটু একটু করে “আমার” বলতে শিখেছিল সে। আজ তার নিজের বলতে যেটুকু কিছু ছিল, তাও দিনদিন কালের হিসাব মেলাতে মেলাতে, ক্ষয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।

এই বিস্তীর্ণ বাংলার তিনটি আলাদা অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ রূপে কলিকাতা হয়ে ওঠবার যেমন একটা ইতিহাস আছে, তেমনই সেদিনের ক্যালকাটা থেকে আজকের কলকাতা হয়ে ওঠবারও একটা দীর্ঘ পথ আছে। এই কলকাতাই তো অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সমগ্র ভু-ভারতের রাজধানী হয়ে উঠেছিল। সেই নবাবী কায়দায় মোঘল আমলের বাদশাহী শাসন থেকে শুরু করে, ধীরে ধীরে পর্তুগীজ আর ফরাসিদের উপনিবেশ গঠন, তারপর ক্রমে জোব চার্নকের হাত ধরে প্রথমে ঔরঙ্গজেব তারপর সিরাজদ্দৌলার দরবার ঘুরে, অর্ধেক কলকাতা রক্তাক্ত করতে করতে, মীরজাফরের সখ্যতার আড়াল ভেদ করে সম্পূর্ণ রূপে বৈদেশিক শাসনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কলকাতা। এরপর কিছু ভালো, কিছু মন্দ, কিছু দ্বিধা, কিছু দ্বন্দ, কিছু লাভ কিছু ক্ষতির ভাগ বাটোয়ারা করতে করতে কলকাতা এগিয়ে গেছে। কখনো সঙ্গী হয়েছে মহাযুদ্ধ, কখনো বা মহামারী আর সবশেষে দুর্ভিক্ষ, যা বাংলার এক শ্রেণীর মানুষের চিরকালীন ভবিতব্যে ঠাঁই পেয়েছে। অবশ্য, এই সুযোগে সারাজীবনই কিছু একচেটিয়া সুবিধাবাদী দালালর্‌ নিজেদের আখেরটা সময় মত গুছিয়ে নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থেকেছে এই কলকাতার বুকেই।

যখন, যে, যেভাবে গোড়াপত্তন করতে পেরেছে কলকাতায়, তখন সে তার রঙে আর চিন্তায় সাজিয়ে নিতে চেয়েছে এই মহানগরীকে। কখনো নগরকেন্দ্রিক, কখনো বন্দরকেন্দ্রিক, কখনো বা শিল্প কেন্দ্রিক, আবার কখনো শুধুই হুজুককেন্দ্রিক হিসেবে গড়ে তোলবার উদ্দেশ্যে এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছে শহরটাকে নিয়ে। সামাজিক আর রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে দেওয়ালের গল্পগুলো বদলে বদলে গেছে। যুদ্ধ হয়ে উঠেছে সংগ্রাম, সংগ্রাম হয়ে উঠেছে বিপ্লব আর বিপ্লব মিশে মিলে গেছে প্রেমের গল্পের পাতায় পাতায়, নকশালজিক বাঙালীর চেতনার অন্তরে অন্তরে। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে কলকাতার ভিতরে লুকিয়ে থাকা গ্রামটা, মহানগরী হতে হতে একটা মধ্যবর্তী পর্যায়ে গিয়ে থমকে গেছে। এর কারণ, উন্নয়ন কিনা জানিনা, তবে অবহেলা তো বটেই। কখনো মাঝরাত্তিরে চিৎপুর কিংবা ডালহৌসি স্কোয়ার ধরে হেঁটে দেখেছেন? মনে হয়না, একটা আর্ত চিৎকার আর কামানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে?

এখনো বিবাদী বাগের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটলে কয়েকটা দোকানের হোর্ডিং-এ “ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি” লেখাটা চোখে পড়ে। কখনো বউবাজারের গলিতে হাঁটতে হাঁটতে হিন্দুস্থান রেকর্ডস এর পুরনো বাড়িটা, টেগোর প্যালেসের ওপর থমকে যাওয়া দিকচক্রটা, কিংবা কুমোরটুলি ঘাট বরাবর বহু ওঠা-নামার সাক্ষী বহন করা আজকের হরর প্লেস পুতুল বাড়িটা, আমাদেরই স্মৃতির বহক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে; এই জীর্ণ শহরের বুকে।


দুদিন আগেও হয়ত যেখানে বড় বড় নীল থামওলা বাড়ির হলুদ নকশাকাটা ঝুল বারান্দাটা, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পাশের ঝকঝকে এগারো তলা অ্যাশ-ব্লু মাল্টিস্টোরেডটাকে বলছিল, “দেখছিস, আমার পাশে তোকে কীরকম মিসফিট দেখাচ্ছে! আসলে তোকে কেউ দেখে না, সবাই এখনো আমাকেই দেখে, বুড়ো হাড়ের কদর বেশী!”, সেও হয়ত কদিন পর কর্পোরেশনের চোখে বিপজ্জনক বাড়ি হয়ে উঠছে। তখন অ্যাশ-ব্লু এর চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যের মোহে, বুড়ো হাড়ের নজরে মরচে পড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এসব পুরনো বাড়িগুলোর বেশীরভাগটাই এখন শরিকী মামলার কবলে। শুধু পায়রা উড়লে টের পাওয়া যায়, প্রাণের অস্তিত্ব।

এসবের পরেও, কোথাও গিয়ে আমার মনে হয় কলকাতার একটা মজ্জাগত অভ্যেস আছে, সবাইকে নিয়েই বাঁচার। তাই একদিকে যেমন জমকালো পার্ক স্ট্রিট, পাব, রেস্তরাঁ, আর নাইট ক্লাবে উত্তাল জনতা উইকেন্ডের সন্ধ্যেগুলোর উল্লাস নিতে পারে, তেমনই অন্যদিকে নিমতলা ঘাটের আনাচে- কানাচে জপের মালা, ধূপ-ধুনো, আর খালি ভিক্ষের পাত্রের পাশে পড়ে থাকা শালপাতায় মোড়া বাসি প্যাঁড়ার পাশে, গঙ্গার হাওয়ায় হাওয়ায় সাধু কিংবা ডোমেদের সাথে মহাকালের আরাধনায় গভীর রাত অবধি অনায়াসে কাটিয়েও দিতে পারে।

কয়েকটা স্মৃতি সৌধ, কিছু টাইলস বসানো পার্ক, কিছু লোভ দেখানো ঝাঁ চকচকে শপিং মল, ক্যাফে আর এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জোড়া চোখে ক্লান্তি এনে দেওয়া একটা রঙের আঁচড়, কোথাও হয়ত প্রাচীন কলকাতাটাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে, আমাদের এই তাৎক্ষণিক জীবনযাপন থেকে। তাই, শুধু হেরিটেজ সিটির নষ্টালজিয়ায় না ঘুরে বেরিয়ে, কোথাও তার প্রাপ্য সম্মানটা দেওয়াও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে নাগরিক হিসেবে। তাকে এই ওলিগলি পাকস্থলীর অন্তরাল থেকে খোঁজাটা আমাদের দায়। আর হয়ত বেশীদিন সে বাঁচবে না। প্রতি মুহূর্তে ভাঙতে থাকবে, পাল্টাতে থাকবে একটু একটু করে। এমন একটা দিন হয়ত আসবে যেদিন, শহরের বুকে ধুঁকতে থাকা, আমাদের ঠাকুরদার আমলের বাড়িগুলো সদ্য মাথা গোঁজা পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়িটার ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়বে, সেদিন রাতের অন্ধকারে লাশ বেওারিশ করা ছাড়া আর কিচ্ছু করার থাকবেনা আমাদের।

তবু, খুব ভালোলাগে যখন দেখি, দক্ষিণের সেকেলে বাড়ির চকমেলানো বারান্দাটা ঘষে মেজে বানানো হয়েছে আধুনিক ভিন্টেজ ক্যাফে। আর ভাললাগে, আধুনিকতার মোড়কে, সাবেকিয়ানাকে বজায় রাখার চেষ্টা করে যেতে। এখনো অদ্ভুত লাগে ভাবতে যখন দেখি, ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক একজন দিকপা্‌ল, কীভাবে সরণী কিংবা অ্যাভিনিউ এর ওপর দিয়ে এসে, স্ট্রিট আর লেন ধরে আমাদের জীবনযাত্রায় সহজে মিশে মিলে গেছে।

আলিনগর থেকে ক্যালকাটা টোয়েনটি টোয়েনটির এই সুদীর্ঘ পথের গল্প একদিনে শেষ হবার নয়। সাতমহলা ঠাকুরদালান থেকে দা ফরটি টু, বনেদী চক্ষুদান থেকে বারোয়ারি ভাসান, নকুড়ের সন্দেশ থেকে চকলেট ব্রাউনি, গঙ্গার পাড়ের হাওয়ায় মাটির ভাঁড়ের চা থেকে, স্টারবাকস্‌ এর চটজলদি আড্ডা, ফিটন, পাল্কী কিংবা ঘোড়ায় টানা ট্রাম থেকে আজকের ওলা উবের আর ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো, গা ভর্তি গয়না ছাড়া বাইশ বছরের সাদা থান পড়া বিধবা তরুণী থেকে অক্সিডাইস খচিত লাল-কালো লিনেন আর অফসোল্ডারে আজকের আধুনিকা – এই সবকিছু জুড়েই একটা বৃহত্তর বেঁচে থাকা রয়েছে।


হাতে সময় বেশী নেই আমাদের। আমার মতে, ছবি খানিকটা জীবন্ত দলিলের মত কাজ করে, সময়টাকে তুলে ধরতে সাহায্য করে। যতদিন মনের ইচ্ছে আর পায়ের জোর আছে, এভাবেই একটু একটু করে পুরনো কলকাতার বাড়ি আর অলিগলি জোড়া স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে গল্প বলে যাব ছবিতে ছবিতে।


দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে, আমাদের একটা প্রবল ইচ্ছের দরকার, তাহলে কলকাতা কলকাতাতেই বেঁচে থাকবে, তার স্মৃতি-স্বত্বার নাগরিকত্ব নিয়ে।


 
 
 

3 Comments


tirtha_chak
May 05, 2020

Extremely well written

Like

pantho.pothergolpo
Apr 27, 2020

অনেক ধন্যবাদ...

Like

Shubham Mukherjee
Shubham Mukherjee
Apr 27, 2020

সুন্দর প্রয়াস। এগিয়ে চলো আরও।

Like

© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page