রবির আলোয় আবৃত- সুরুল সরকারবাড়ি
- Shrabanti Mitra
- May 24, 2022
- 4 min read
Updated: May 27, 2022

ভাঙা কার্নিশ, শ্যাওলামাখা সিঁড়ি, খসে পড়া ইঁটের খাঁজে খাঁজে গজিয়ে ওঠা শিকড়, এদিকে-ওদিকে ঝোপঝাড়, চাঙর ভেঙে পড়ার শব্দ- এই যা যা শব্দচয়ন জমিদারবাড়ি শুনলেই চট করে মাথায় আসে, তার সম্পূর্ণ বিপরীত একটা দিক খুব তেমন পাওয়া যায়না, বিশেষত আমাদের পশ্চিমবঙ্গে। তবে, এই আলট্রা আধুনিকতার যুগে, যত সংখ্যক জমিদারবাড়ি জীবিত আছে এখনো, তার মধ্যে যে গুটিকয়েক বাড়ি, পরিবারের সকলের কল্যাণে এখনো তার গৌরব ধরে রাখতে পেরেছে, তার মধ্যে সুরুল সরকারবাড়ি অন্যতম।

শান্তিনিকেতনের একটা অংশ যেমন রবীন্দ্র ছায়াবৃত, তেমন করেই সেই ছায়ার পরম স্পর্শ পড়েছিল, আশ্রম থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে এই সুরুল গ্রামে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের আশ্রম গড়ে তোলবার জন্য সেসময় জমি কেনেন, এই সরকার পরিবারের থেকেই। এখানে গুরুদেবের কুঠিতে এক সময় সাংস্কৃতিক চর্চাও হত।

১৭৮২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে সুরুলে ব্যবসা বানিজ্য স্থাপন করেন জন চিফ, ভরতচন্দ্র সরকারের সাথে যৌথ উদ্যোগে, যার দরুন জন চিফের অধীনে একটি কমার্শিয়াল রেসিডেন্স তৈরি হয় এখানে। ১৮৩৫ সালে কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্য এই অঞ্চলে বন্ধ হবার পর, যথারীতি এটি একটি পরিত্যক্ত স্থানে পরিণত হয়। বর্তমানে এর কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুরুলে সেই সময়ে আদি বসবাস ছিল, বাগদি, বাউড়ি, হাড়ি ও ডোম বর্ণভুক্ত মানুষজনের। এর পরবর্তীকালে সরকার পরিবারের জমিদাররা ব্রাহ্মণ প্রজাতির লোকজন এনে এখানে বসতি গড়ে তোলেন।

হালকা নীল, হলুদ, আর গাঢ় সবুজ রঙের জানলা ঘেরা একটা উজ্জ্বল বাড়ি। ভেতরে চতুষ্কোণ নাটমন্দির, যার আড়ালে আবডালে সিসিটিভি লাগানো। এই প্রথম দেখা কোনো জমিদারবাড়িতে সিসিটিভির উপস্থিতি, বেশ অবাক করেছিল আমায়। বাড়ির প্রতিটা অংশ আলাদা আলাদা ভাবে সুনির্দিষ্ট এবং বিভক্ত। প্রত্যেকটা জায়গাকে তার মত করে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে দেখলাম।

সুরুল সরকারবাড়ি, ছোট তরফের দুর্গাদালান
সুরুল সরকারবাড়ি দু'টি ভাগে বিভক্ত, একটি বড় বাড়ি, অপরটি ছোট বাড়ি। বড় বাড়িটি যে কোন সংস্কারমূলক কাজের জন্য সবসময়ই প্রধান ভূমিকা পালন করে। মূল বাড়ির মাঝখানে রয়েছে থামযুক্ত নাটমন্দির, আর সিঁড়ি বেয়ে উঠে পাঁচ খিলানের ঠাকুরদালান, এখানেই প্রতি বছর জাঁকজমক সহকারে দুর্গাপুজো হয়। সুরুল পরিবারের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আর তার বৈচিত্রপূর্ণ সমারোহ এখনো একই ভাবে জনপ্রিয়। সে গল্প না হয় আরেকদিন বলব। আজ বরং সরকারদের কথা বলি একটু।

সরকার বাড়ির পুরোনো অংশ
ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেল, অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে বর্ধমানের নীলপুর থেকে সুরুলে আসেন ভরতচন্দ্র সরকার। তাঁর কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি তাঁর গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে কাশী যাবার পূর্বে সাক্ষাৎ করতে আসেন। গুরুদেবের আশীর্বাদধন্য হয়ে বহুবিধ পূজাপাঠের ফলে ভরতচন্দ্র পুত্র সন্তান লাভ করেন। এরপর থেকেই ভরতচন্দ্র তাঁর পুত্র কৃষ্ণহরি সহ গোটা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করা শুরু করেন সুরুলে এবং তাঁর সময় থেকেই এই পরিবারে জমিদারির সমৃদ্ধি ঘটতে আরম্ভ করে।

সরকার বাড়ির পুরোনো অংশ
ভরতচন্দ্রের পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ কৃষ্ণহরি সরকারের তিন পুত্র - মাধবেন্দ্র, যাদবেন্দ্র এবং কালীচরণ, এঁদের আমলেই সুরুল সরকার পরিবার বড় বাড়ি ও ছোট বাড়ি এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে মাধবেন্দ্র সরকার ছলে যান বড় বাড়ির দিকে, অন্যদিকে যাদবেন্দ্র সরকার চলে যান ছোট বাড়ির দিকে। এই পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন শ্রীনিবাস সরকার, ইংরেজ আমলে নীল আর কাপড়ের ব্যবসা করে তিনি প্রভূত সুনাম অর্জন করেন একসময়ে। এই পরিবারের মূল আয়ই ছিল নীলের চাষ থেকে। এছাড়াও মোটা থান এবং জাহাজের পালে ব্যবহৃত জিন্সের কাপড় তৈরি হতো এখানে। এর সঙ্গে চিনির ব্যবসা ছিল পারিবারিক আয়ের আরেক উৎস। যদিও ভরতচন্দ্রের আমল থেকেই দুর্গাপুজো শুরু হয় এই পরিবারে, কিন্তু তাঁর আমলে মানে এই পরিবারের একেবারে গোড়ার দিকে মাটির দালানে দুর্গা আরাধনা করা হতো। তাই পরবর্তীকালে প্রভূত খ্যাতি এবং ব্যবসায়িক ধনসম্পদ লাভের পর শ্রীনিবাস সরকার পাকা দুর্গা মন্দির বানিয়ে পুনরায় জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন এ বাড়িতে।

সুরুল সরকারবাড়ি, বড় তরফের দুর্গাদালান
সুরুল গ্রামের টেরাকোটা মন্দিরগুলির মধ্যে, জমিদারবাড়ি সংলগ্ন ত্রিখিলানবিশিষ্ট পঞ্চরত্ন লক্ষ্মী-জনার্দনের মন্দিরটিতে টেরাকোটার কারুকাজের মাধ্যমে রাম রাবণের যুদ্ধের বেশ কিছু দৃশ্য বিস্তারিত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

সরকার বাড়ির ত্রিখিলানবিশিষ্ট পঞ্চরত্ন লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দির
মন্দিরের প্যানেলগুলিতে কিছু স্থাপত্যশৈলী এখনো অক্ষত থাকলেও, এটির সংস্কারের বিশেষ প্রয়োজন।

টেরাকোটার কারুকাজে রাম রাবণের যুদ্ধের দৃশ্যাবলী


এছাড়া গলির ভেতর পাশাপাশি দু'টি রেখ দেউল স্থাপত্যশৈলীর শিবের মন্দির রয়েছে। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা লিপি থেকে জানা যায় ১৮৩১ সালে শ্রীনিবাস সরকার মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।

সুরুল সরকারবাড়ির রেখ দেউল স্থাপত্যশৈলীর জোড়া শিব মন্দির
এই মন্দিরদুটিকে যে যথাসম্ভব রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তা মন্দিরগুলি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সে কারণে মন্দিরের গায়ের সুক্ষ্ম টেরাকোটার কারুকাজও এখনো বেশ উজ্জ্বল। এই দুটি শিব মন্দিরের মধ্যে একটিতে লক্ষ করা যায় রামসীতা যুগলে উপবেশন করেছেন মধ্যিখানের প্যানেলে। সঙ্গে দুপাশে রয়েছে হনুমান জাম্বুবান সহ ঢাল তলোয়ার হাতে সৈন্য এবং অন্যধারে ইউরপিয়ান পোশাক পরিহিতা নারীমূর্তি। এর পাশের মন্দিরটিতে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায় সপরিবারে মা দুর্গার উপস্থিতি। এছাড়াও এই দুটি শিব মন্দিরে দশাবতারসহ বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাবলী চিত্রিত রয়েছে।


বাঁ দিকে রামসীতা সহ রামায়ণের দৃশ্যাবলী; ডানদিকে সপরিবারে মহিষাসুরমর্দিনী
এছাড়াও সুরুলের পশ্চিম পাড়ায় রয়েছে একটি আটচালা মন্দির এবং রেখ দেউলাকৃতির আরও একটি শিব মন্দির।


পশ্চিম পাড়ার আটচালা মন্দির এবং রেখ দেউলাকৃতির শিব মন্দির
এই শিব মন্দিরের টেরাকোটা প্যানেলগুলি এখনো স্পষ্টত দ্রষ্টব্য থাকার কারণে একদম উপরিভাগের কারুকাজ লক্ষ করলে দেখতে পাওয়া যায় স্বয়ং শিব তানপুরা বাজাচ্ছেন মধ্যমণি হয়ে বসে।

ওপরের প্যানেলে শিব বাদ্যযন্ত্র সঙ্গতে মগ্ন, মধ্যিখানের প্যানেলে রামসীতা সহ বিভিন্ন সামাজিক দৃশ্যাবলী
আমার দেখা জমিদারবাড়িগুলির মধ্যে সুরুল সরকারবাড়ি অন্যতম, যাকে রক্ষণাবেক্ষণে আমি দশে ন’ নম্বর দেব। একটা বাড়ির প্রাচীনত্বকে বজায় রাখা যে কতখানি দরকার, এবং পরিবারের সকলের স্বদিচ্ছা থাকলে তা যে আদপে সম্ভব, তা সুরুল সরকারবাড়িতে না এলে বোঝা যেত না। এখনো, এই পরিবারের মানুষজন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সারাবছর ধরে, এ বাড়ির ঐতিহ্যকে বজায় রাখার চেষ্টা করে। সে কারণেই বোধহয়, এখনো প্রতিবছর দুর্গাপুজোয় দূর দূর থেকে এতো পর্যটক এসে ভিড় করেন এই বাড়িতে। ইতিহাস তখনই বর্তমানের আঙিনায় নতুন রূপে সজ্জিত হয়, যখন তাকে সজ্জীবিত রাখার উৎসাহকে কার্যকর করে তুলতে পারে মানুষ।

কোনো বাড়িই একদিনে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষিত হয়নি। দীর্ঘদিনের শ্রম, ঐতিহ্যমনস্কতা আর স্থাপত্যশিল্পের ফলই আখ্যা নিয়েছে হেরিটেজ রূপে। তাই, এই দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসলকে আগলে রাখতে গেলে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে, তাকে আবার আগের মর্যাদায় ফেরত নিয়ে যেতে হয়। আর তা সেই পরিবারের মানুষজনের পক্ষেই সম্ভব হয়। এখনো যতটুকু সময় আছে, তার মধ্যেই যদি বাকি পরিবারগুলিও এভাবে এক হতে পারতেন, তাহলে বাংলার জমিদার তথা রাজপরিবারগুলির খ্যাতি বাড়ত বৈ কমত না।
⮚ পথনির্দেশঃ
বোলপুর স্টেশন বা শান্তিনিকেতনের যে কোনো জায়গা থেকে শ্রীনিকেতন মোড়ে টোটো বা অন্য যে কোনো গাড়ি ধরে চলে এলে ডানদিকে যে সরু রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে, সেটা ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই সুরুল সরকার বাড়ি। দুর্গাপুজো ছাড়া অন্য সময়ে এলে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে আসাই ভালো।

Comments