top of page

ওলন্দাজ নগরী চিনসুরা

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Apr 26, 2022
  • 12 min read


কলকাতা থেকে সবচেয়ে কাছাকাছি দুরত্বে যদি বিদেশ যেতে হয়, ভিসা পাসপোর্টের জটিল ঝামেলায় না জড়িয়ে, টুক করে একটা লোকাল ট্রেনে চেপে, তাহলে আমার মনে হয় হুগলীর চেয়ে সুখকর জায়গা আর কিছু হতে পারেনা। এবার এই হুগলীর মধ্যে যে তিনটি শহরে সবথেকে বেশী বৈদেশিক প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেগুলি হল- শ্রীরামপুর, চন্দননগর ও চুঁচুড়া। এই তিনটের কোন একটি জায়গায় একটা গোটা দিন ভালো করে ঘুরলেই বোঝা যাবে এই সমস্ত জায়গায় পর্তুগীজ, ফরাসি এবং ওলন্দাজেরা কীভাবে সুবুদ্ধি খাটিয়ে ঘাঁটি তৈরি করেছিল নিজেদের। আর এই সবকটি শহরে বাংলার ঐতিহ্যের পাশাপাশি, সেই সমস্ত ঔপনিবেশিক শাসনের নিদর্শন আজও আমরা আগলে রেখেছি কিছুটা হলেও।



আজ বলব আমাদের ওলন্দাজ নগরী চুঁচুড়ার কথা। সামগ্রিক ভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, চুঁচুড়ার হেরিটেজের যে বৈচিত্র, তা আর অন্য কোথাও এত বিস্তৃত নেই সারা বাংলায়। তাই, ব্যান্ডেল, হুগলী, চুঁচুড়া এই তিনটি শহরকে একসাথে জুড়ে ১৮৬৫ সালে গড়ে উঠেছিল হুগলী জেলার সদর হিসেবে চুঁচুড়া পৌরসভা। এখানে একদিকে যেমন আছে প্রাচীন মন্দির, তেমনি আছে মসজিদ ও দরগা, আর তাছাড়া গির্জা কিংবা কবরস্থান তো এই শহরকে স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে সেই গোড়া থেকেই।



চুঁচুড়া গড়ে ওঠবার কথা লিখতে গেলে চলে যেতে হয় একেবারে সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তখনও ব্রিটিশ শাসকেরা কব্জা করতে পারেনি আমাদের দেশটাকে। তার আগেই পর্তুগীজ আর ওলন্দাজরা মোটামুটি রমরমা শুরু করে দিয়েছিল এই হুগলীতে। তার মধ্যে চুঁচুড়ায় শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়েছিল ওলন্দাজেরা। ইন্দোনেশিয়ার বাজারে মশলার ব্যবসা করতে করতে, তারা টের পেয়েছিল, সেখানে বাংলার সুতির কাপড়ের চাহিদা আছে। তাই সুতির কাপড়ের জোগানে তারা ভারতে হানা দেয়। পর্তুগীজরা ১৬৩২ সালে মুঘলদের দ্বারা বাংলা থেকে বিতাড়িত হলে, ওলন্দাজেরা চুঁচুড়াতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ে এবং ১৬৪৫ সালে দিল্লীর মুঘল সম্রাট, শাহজাহানের থেকে ফর্মান পাবার দৌলতে সেখানে একটি বাণিজ্য কুঠি তৈরি করে। এরপর তারা তাদের বানিজ্যতন্ত্র এবং আধিপত্য দুইই ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে গোটা চুঁচুড়া জুড়ে। যার ফলশ্রুতি হিসেবে, এর পরবর্তী দেড়শ বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা ডিভিশানের ডিরেক্টরেট হিসাবে কাজ করে এই ডাচেরা এবং সেকালের চিনসুরা একটি আদ্যন্ত ওলন্দাজ নগরীতে পরিবর্তিত হতে থাকে প্রায়।


তাই কবি অন্নদাশঙ্কর রায় পরবর্তী সময়ে লেখেন,


“হাঁসের প্রিয় গুগলি/ পর্তুগিজদের হুগলী,

গুনের প্রিয় তানপুরা/ ওলন্দাজদের চিনসুরা।”



তবে, শুধুমাত্র বৈদেশিক শাসনতন্ত্রের নিদর্শন হিসেবেই চুঁচুড়া মর্যাদা পায়নি, এর পাশাপাশি বাংলার প্রাচীন স্থাপত্য, শিল্প-সংস্কৃতি এবং সাহিত্যেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখে গেছে সেকালের চিনসুরা।

আমি চুঁচুড়ার যতগুলো জায়গায় যেতে পেরেছি, সেই সবকটি স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেল না, তাই যেগুলির ব্যাপারে পেলাম, সেগুলি নিয়েই বিস্তারিত লিখব এখানে। ভবিষ্যতে ঐ সমস্ত জায়গার বিষয়ে তথ্য পেলে, আবার লিখব বরং।


একচালা নন্দলাল মন্দির


আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল চুঁচুড়া থেকে একটু পিছনের দিকে এসে, চন্দননগরের নন্দলাল মন্দির দিয়ে। এই মন্দিরটি হুগলীর অন্যতম প্রাচীন একচালা মন্দির। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৪০ সালে ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী। যদিও পরবর্তীকালে, মন্দিরের সংস্কার হয়ে এর স্থাপত্যের অনেকটাই মুছে গেছে, তবুও এখনো ফাঁকা মাঠের ওপর এমন কুঁড়েঘর আকৃতির মন্দির দেখতে বেশ অন্যরকম লাগে।


মন্দিরের অভ্যন্তরে কৃষ্ণের বিগ্রহ


এরপর চুঁচুড়ার পথে এগোতে এগোতে দেখতে পেয়েছিলাম একটি প্রাচীন কারুকাজ করা বাড়ি, কৌতূহলবশত, নেমেছিলাম ভেতরে ঢুকে দেখব বলে। বাড়ির একদম ওপরে একটি মূর্তি আছে, যার নীচে লেখা নৃত্যগোপাল স্মৃতিমন্দির।


ঐতিহ্যপূর্ণ চন্দননগর লাইব্রেরি


এটি এখন চন্দননগর পুস্তকাগার, যেটি ১৮৭৩ সালে স্থাপন করা হয়েছিল। বাড়ির একটা অংশে যদিও নতুন রঙ করা হয়েছে, তবুও মূল অংশের স্থাপত্যের কারুকাজ এখনো বেশ সুস্পষ্ট। দোতলায় বড় বড় থামযুক্ত গোলাকৃতি ব্যালকনি, আর বাড়ির একধারে সাদা পাথরের কারুকাজ করা ফোয়ারাটি দেখে সত্যিই বিস্ময় জাগে।



এরপর সরাসরি চুঁচুড়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আমার প্রথম গন্তব্য ছিল সুসান্না আন্না মারিয়ার সমাধি। “সাত খুন মাফ” ছবিটা নিশ্চয়ই আমরা অনেকেই দেখেছি। অনেকে এও জানি যে, ছবিটি রাসকিন বন্ডের লেখা Susanna’s Seven Husband বইটি অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল। তবে, আমরা অনেকে যেটা জানিনা সেটা হল, এই বইটি কোন ঘটনার অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছিল। আজ সেটাই জানব এই সমাধিস্থলের গল্পে ঘুরতে ঘুরতে।


সুসান্না আন্না মারিয়ার সমাধিস্থল


সুসান্না আন্না মারিয়া নেদারল্যান্ড নিবাসী হলেও, পরবর্তীকালে ১৭৫৯ সালে এক ওলন্দাজ ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে চলে আসেন চুঁচুড়ায়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে পিটার ব্রুইসের মৃত্যু হয়। আর সেসময় থেকে ডাচ নগরী চলে যায় ব্রিটিশ সরকারের হাতে। এরপর ১৭৯৫ সালে সুসান্না আন্না মারিয়া দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ীকে। চুঁচুড়া ও চন্দননগরের মাঝে ষাট বিঘা জমির ওপর সুসান্না আন্না মারিয়ার উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত এক বিশাল বাগান বাড়ি ছিল। তাঁর ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর পর তাঁকে যেন এই বাড়িতেই সমাধিস্থ করা হয়। তাই তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে রাজকীয়ভাবে সমাধিস্থ করা হয়, তাঁর প্রিয় বাগানবাড়ি- আয়েশবাগে।



তবে এই কাহিনীর সঙ্গে সাত বিবির লৌকিক কাহিনীর কতটা সম্পর্ক ছিল, তা স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়না। খাতায়-কলমে সুসান্না আন্না মারিয়া দু'বার বিয়ে করেন। আর বাকি বিয়ের খবরগুলো ফুটে উঠেছে গল্পের পাতায়। দু'শো বছরের বেশী প্রাচীন এই সমাধিস্থলের স্থাপত্যে রয়েছে, গ্ৰিক স্থাপত্যের সাথে ইন্দো-ডাচ স্থাপত্যের অপূর্ব মেলবন্ধন, যা ফরাসি ও ভেনিসের ব্যারক রীতির আদলে গড়ে উঠেছে খানিকটা। এর গোলাকার গম্বুজটির ওপরে একটি ব্রোঞ্চের ঘণ্টা আগে ছাদ থেকে ঝোলানো হত। বর্তমানে সৌধটি আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্বাবধানে রয়েছে।


ষন্ডেশ্বরতলার মন্দিরপ্রাঙ্গন


আমার এর পরের গন্তব্য ছিল ষন্ডেশ্বরতলা। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির ও ঘাট। এখানে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়বে কালো পাথরের একটি প্রাচীন মূর্তি। তবে, এর স্থাপনকালের বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি।



এরপর বাঁ দিকে রয়েছে একটি বিপত্তারিনী কালী মন্দির ও জোগাদ্যা দুর্গা মন্দির, ডানদিকে একটি নাটমন্দির। এছাড়া রয়েছে একটি রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরও।



এর ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে আদি ষন্ডেশ্বর জীউয়ের মন্দির। এই ৬ তলা বিশিষ্ট মন্দিরটি ১৯৭৯ সালে মন্দিরাকারে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত হয়। বলা হয়, এই মন্দিরের শিবলিঙ্গটির উৎপত্তি হয়েছে ভাগীরথী নদী থেকে।


বাবা ষন্ডেশ্বরজীউ


এছাড়াও ভৈরবের সাতটি শিলামূর্তি, একটি ত্রিশূল ও তামার পাতাও উদ্ধার হয় সেই সময়। ৫০০ বছরের প্রাচীন এই ষন্ডেশ্বরতলার গাজন উৎসব, সারা বাংলায় খুবই জনপ্রিয়। নিরিবিলি মন্দির প্রাঙ্গণ সংলগ্ন ঘাটটিও খুবই প্রাচীন। এটি ষন্ডেশ্বরতলার পরিবেশকে আরও স্নিগ্ধ এবং পবিত্র করে তুলেছে।


শীলেদের ঠাকুরবাড়ি, বর্তমানে পোস্ট অফিস


এরপর চলতে চলতে দেশবন্ধু হাই স্কুলের পাশে দেখা মিলল একটি জীর্ণপ্রায় পুরোনো বাড়ির। ফের সেই কৌতূহল। সুতরাং, নেমে পড়া। জানা গেল, এটি আগে ছিল চুঁচুড়ার বিখ্যাত শীল পরিবারের ঠাকুরবাড়ি, যেটি এখন পোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে মূল বাড়িটি ফাঁকাই থাকে। বাড়িটি আদতে এখন পোড়োবাড়িই বলা চলে। যে কোনো সাবেকি বাড়ির ঠাকুরদালানের মতোই চেহারা এ বাড়ির, শুধু রঙ খসে পড়ে আভ্যন্তরীণ ইঁটের চেহারা বাইরে প্রকাশ পেয়েছে এই যা।


এই বাড়ির উল্টোদিকেই রয়েছে চুঁচুড়ার আরেক বনেদী পরিবার আঢ্যদের বাড়ি। এখানেও বহু বছর ধরে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে।


ডাচ সিমেট্রি


এরপর গেলাম চুঁচুড়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান ডাচ সমাধিক্ষেত্রে। বিশাল এলাকা নিয়ে ১৭৪০ সালে গড়ে তোলা হয় এই সমাধিস্থল। এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশে কোনরকম বাধানিষেধ নেই আর টিকিটেরও কোন ব্যাপার নেই। ১৮-১৯ শতকে চুঁচুড়ায়, যখন ওলন্দাজদের রমরমা ছিল এই অঞ্চলে, তখন ডাচেদের সমাধি দিতে নিয়মিত ব্যবহার করা হত এই ক্ষেত্রটি। এখানে সবচেয়ে প্রাচীন কবরটি আছে কর্ণেলিয়াশ জঙ্গের, যিনি মারা যান ১৭৪৩ সালে। মোট ৪৫টি ডাচ কবর এখানে রাখা হয়েছে, যার মধ্যে কিছু কবর আছে পিরামিড আকৃতির, কয়েকটি সাধারণ সমাধিপ্রস্তর হিসেবেই আছে, আর বাদবাকি বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে।



একটি সমাধি যেটি আলাদা ভাবে চোখে পড়ল সেটি হল, জর্জ অ্যালফ্রেড ডেভিডের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ছায়া রানী ডেভিডের কবর, যিনি ২০০২ সালে মারা যান। তাঁর মানে কোথাও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীতেও এখানে ওলন্দাজ ব্যক্তি বাস করেছেন এবং বাঙালি মহিলার সঙ্গে এঁদের কারোর কারোর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল।



এই সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেষ গভর্নর ড্যানিয়েল অ্যান্টনী ওভারবেকের সমাধি। এছাড়াও আছে সুসান্না আন্না মারিয়ার প্রথম স্বামী পিটার ব্রুইসের সমাধি। ১৯৯৩ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এই সমাধিক্ষেত্রটি প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে এটি আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্বাবধানে রয়েছে।



সমাধি ছাড়াও এই বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে অসংখ্য গাছ ও পাখী। তবে, গাছগুলিকে এমন ভাবেই রাখা হয়েছে যাতে সমাধিস্থানে যেতে কারো কোন বাধাসৃষ্টি না হয়। একটি পুরোনো কবরের ওপর, ঝরে পড়া চাঁপাফুল দেখে মনে হল, এমনই কত না অতীতের স্মৃতিজোড়া প্রেমগাঁথার সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়েছে, এখানকার গাছেরা।


মতিঝিল


এখান থেকে বেরিয়ে গেলাম মতিঝিল পুকুর। একসময় গোটা চুঁচুড়া শহরে মতিঝিল পুকুর থেকে জল সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে যেখানে এই পুকুরটি আছে, সেখানে আগে হেদো, মক্কা ও মতিঝিল নামে ৩টি পুকুর ছিল। পরবর্তীকালে এই তিনটি পুকুর একসাথে মিলে মতিঝিল পুকুর নামে পরিচিত হয়েছে।



এর ঠিক পিছনেই বাঁ দিকে ছোট্ট জায়গা নিয়ে রয়েছে ইয়া হজরতে আব্বাস দরগা আর পুকুরের ঠিক ওপারেই রয়েছে বের আলিফ খান মসজিদ বা মতিঝিল মসজিদ


ইন্দো-পার্সিয়ান স্থাপত্যশৈলী


এই মসজিদের ইতিহাসের ব্যাপারে লিখতে গেলে বলতে হয়, শুধু ওলন্দাজরাই যে এখানে ব্যবসা করতে এসেছিলেন, তা নয়। তারপর ইরানিরাও এখানে এসে ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। সেই সুত্র ধরেই এখানে আসার পর, জমিদার নাসরাতউল্লাহ খান তাঁর বাবার স্মৃতিতে ১৮৩৩ সালে এই মসজিদ গড়ে তোলেন। শিয়া সম্প্রদায়ের এই মসজিদটি ইন্দো-পর্সিয়ান স্থাপত্যের মেলবন্ধনে তৈরি, বলা যায় মক্কা শরীফের কাবারের আদতে। এখনও বিশেষ দিনগুলিতে এই মসজিদে নামাজ, আদায় সহ বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। তবে রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে এই বিরল ইন্দো-পার্সিয়ান স্থাপত্যের আজ করুণ অবস্থা। এছাড়া এর আশেপাশে আগাছার ভিড়ে, জায়গাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন একটু একটু করে। চুঁচুড়ার অন্যান্য বিশেষ স্থানগুলির মত এটিকেও আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার আওতায় আনতে পারলে মসজিদটিকে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে।


ঘড়ির মোড়


এরপর গেলাম চুঁচুড়ার অন্যতম জনপ্রিয় ল্যান্ডমার্ক ঘড়ির মোড়ে। চুঁচুড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই ঘড়ির মোড়, এ শহরের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে গড়ে ওঠবার পিছনেও একটি ইতিহাস আছে।

রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড বা অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড ছিলেন ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র, যিনি রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালের ৯ই আগস্ট ব্রিটেন ও ভারতবর্ষের শাসনকর্তা হিসেবে অভিষিক্ত হন। কিন্তু মাত্র ৯ বছর রাজত্ব করার পরেই, ১৯১০ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁরই স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯১৪ সালে এই “এডওয়ার্ডিয়ান ক্লক টাওয়ার” বা স্তম্ভঘড়িটি স্থাপন করা হয়।



এই স্তম্ভঘড়িটির চারদিকে চারটি ঘড়ি এবং ওপরে একটি ধাতব ঘন্টা রয়েছে। এছাড়া স্তম্ভটির গায়ে একটু নীচে রয়েছে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের একটি ধাতব পার্শ্বমূর্তি এবং বাকি তিনদিকে তিনটি কারুকার্যখচিত স্মৃতিফলক। ঘড়িস্তম্ভের একপাশে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূপতি মজুমদারের ভাষ্কর্য। রাতের অন্ধকারে এই ঘড়ির স্তম্ভ, ইতিহাসের মত জ্বলজ্বল করে চুঁচুড়ার বুকে।


চুঁচুড়ার ব্রিটিশ চার্চ


এরপর খাওয়াদাওয়া সেরে গেলাম চুঁচুড়া চার্চ। ঘড়ির মোড়ের এই জমজমাট পরিবেশে, বাজারদোকানের ভিড়ের ফাঁকে, ছোটখাটো এই চার্চটি অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয় না অনেকসময়। তবে, এটিও চুঁচুড়ার অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। তবে, আসল ব্যাপার এই যে, চার্চটি আসলে চুঁচুড়ায় ইংরেজ শাসনতন্ত্র স্থাপনের একটি ভিত্তিপ্রস্তর; ইঙ্গ-ডাচ চুক্তির ফসল।

ভারতে যখন ব্রিটিশ সরকারের শাসন রমরমিয়ে চলছে, ঠিক সেরকম একটা সময়ে ওলন্দাজরা ঠিক করেন, ভারত থেকে ব্যবসার পাট চুকিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দিকে রওনা দেবেন, কারণ ওখানে তখন তাঁদের ব্যবসা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। এদিকে ইংরেজরা পুরোপুরি ভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মালয় দ্বীপপুঞ্জে, তাঁদের নিজস্ব ব্যবসা-বানিজ্যের ঘাঁটি ছেড়ে চলে আসতে উদ্যোগী হচ্ছেন এই ভারতবর্ষে, নিজেদের শাসনতন্ত্রকে স্বমূলে বিস্তার লাভ করতে। ফলে ইংরেজ ও ডাচ- এই দুই পক্ষই ১৮২৪ সালে একটি যৌথ চুক্তির মাধ্যমে উভয়ের উপনিবেশ হস্তান্তরিত করেন। ফলে, ১৪০ বছর পর হুগলী ইংরেজদের দখলে আসে ১৮২৫ সালে এবং সেই বছরই তৈরি হয় চুঁচুড়া চার্চ।

এই চার্চের প্রথম পাদ্রী ছিলেন রেভারেন্ড মাইকেল জন, যিনি ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত এই চার্চের দায়িত্ব সামলান। এরপর ১৮৭১ সালে রেভারেন্ড পি. কে. চ্যাটার্জি প্রথম বাঙালী পাদ্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এই গির্জার। ২০০২ সালে এই গির্জার সংস্কার হওয়ার ফলে, কিছু স্থাপত্যচিহ্ন নষ্ট হয়ে যায়। তবে, এর সামনের দিকের টালির চালটি এখনো অক্ষত রয়েছে, যা সচরাচর কলোনিয়াল যুগের কোনো স্থাপত্যে চোখে পড়েনা।


জেলা জজ আদালত, হুগলী


ঘড়িঘরের দক্ষিণে চুঁচুড়া শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চুঁচুড়া কোর্ট। ধ্বংসীভূত ওলন্দাজ দুর্গ গুস্তাভার থেকে সরঞ্জাম এনে ১৮২৯ সালে স্থাপিত হয় এটি। ভারতীয় কোর্টগুলির মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম বারান্দাটি রয়েছে এই জেলা জজ আদালতটিতে। ব্রিটিশ আমলের অনেক বড় বড় মামলা, আর কারাদণ্ডের সাক্ষী আছে এই চুঁচুড়া কোর্ট।



চুঁচুড়া কোর্টের উল্টোদিকেই অবস্থিত পুলিশ লাইন, যা এখন সরকারি পুলিশ অ্যাকাডেমিতে পরিণত হয়েছে। এর ভেতরের বাড়িগুলি সরকারি অফিসের কাজে ব্যবহার করা হয়। আগে এই ভবনটি ব্রিটিশ সেনা ছাউনি ও হাসপাতালের অন্তর্গত ছিল। এই পুলিশ ভবনের একতলার একটি বাড়িতে রয়েছে একটি বিস্তৃত বারান্দা। এছাড়া ভেতরের কয়েকটি বাড়ির দরজা ও জানলায় ডাচ স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন লক্ষ করা যায়।


আর্মেনিয়ান চার্চ


চুঁচুড়ায় ডাচ এবং ব্রিটিশদের পাশাপাশি অল্পসংখ্যক আর্মেনিয়ান জনসমাজের মানুষজনও বসবাস করেছিলেন এক সময়। তারপর তাঁরা কেবল চুঁচুড়া থেকে না, সমগ্র ভারত থেকেই আসতে আসতে বিদায় নেন। মাত্র কয়েকজন লোক এখনো আছেন এদেশে, তাঁরা শুধুমাত্র পারিবারিক এবং ধর্মীয় কারণে এখনো যাতায়াত করেন এখানে। বাংলায় যেক'টি আর্মেনিয়ান চার্চ আছে, তারমধ্যে চুঁচুড়ার আর্মেনিয়ান চার্চটি বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম চার্চ। ১৬৯৫ সালে চুঁচুড়ার শেষ ডাচ গভর্নর ড্যানিয়েল অ্যান্টনি ওভারবেক এর ভিত্তিপ্রস্তর করেন। ১৬৯৫-১৬৯৭ সালের মধ্যে আর্মেনিয়ান খোজা জোসেফ মার্গার তৈরি করেন এটি। এরপর ১৮২২ সালে সোফিয়া বাগ্রামের পৃষ্ঠপোষকতায় ও তাঁর স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই চার্চের সুউচ্চ চূড়াটি নির্মাণ করা হয়। এই চার্চে শেষ বিবাহিত হন, জোসেফ বেগলা নামে একজন আর্মেনিয়ান ১৮৬৮ সালে এবং এখানে শেষ সমাধি স্থাপন করা হয় ১৮৮১ সালে। এই চার্চের স্থাপত্যশিল্পে গ্রীক রীতির নিদর্শন লক্ষ করা যায়। এই চার্চটি সেন্ট জন ব্যাপ্টিস্ট চার্চ নামেও পরিচিত।



সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল, এই চার্চে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। তবে কলকাতার বড়বাজারে যে আর্মেনিয়ান চার্চটি আছে, সেই চার্চের আধিকারিকের থেকে অনুমতি নিয়ে যদি কেউ এই চার্চে আসেন, তবে এই চার্চের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয়/ তৃতীয় রবিবার এই চার্চে বিশেষ বাৎসরিক উৎসব পালন করা হয়।


জোড়াঘাট


এরপর এগিয়ে গেলাম চুঁচুড়ার অন্যতম প্রাচীন দ্রষ্টব্য জোড়াঘাটের দিকে। এই জোড়াঘাটের আগের নাম ছিল “মল্লিক কাশিম হাট”। তবে, ঘাটের নাম জোড়াঘাট হবার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে একটা অন্যরকম গল্প।

১৬৩২ সাল পর্যন্ত হুগলী শহর ছিল কার্যত পর্তুগীজদের অধীনে। এই সময়ে মুঘল বাহিনী পর্তুগীজদের যুদ্ধে পরাজিত করে, হুগলী দখল করে এখানে ফৌজদারি প্রথা চালু করে। ১৬৬৮ থেকে ১৬৭২ সাল পর্যন্ত হুগলীর ফৌজদার ছিলেন জনৈক মালিক কাশেম। তাঁর নামেই এই ঘাটের নাম হয়, “মল্লিক কাশিম হাট”। জলপথ বেয়ে আসা ফিরিঙ্গী জলদস্যুদের উপর নজরদারির জন্য তিনি হুগলীর পূর্ব সীমানায় গঙ্গার তীরে একটি বিশাল দুর্গ-প্রাসাদ নির্মাণ করেন। গঙ্গার পার বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত এই দুর্গ-প্রাসাদটির অংশ হিসেবে ছিল দু'টি গঙ্গার ঘাট– একটি মালিক কাশেমের পরিবারগণের ব্যবহারের জন্য, অন্যটি সর্বসাধারণের জন্য। এই জোড়া স্নানের ঘাট থেকেই পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের নাম হয় জোড়াঘাট।



স্থাপত্যের ইতিহাসের পাশাপাশি, সাহিত্যেরও ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভূমিকা আছে, এই চুঁচুড়া শহরকে সামগ্রিক ভাবে গড়ে তোলার জন্য। যার বিশেষ অবদান রেখে গেছেন স্বয়ং সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন হুগলী মহসিন কলেজের ছাত্র, পরবর্তীকালে ১৮৭৬ সালের ২০শে মার্চ তিনি হুগলীতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেকটরের পদে যোগদান করেন। নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় গ্রামের বাড়ি থেকে নৌকায় ভাগীরথী পার করে প্রথম দিকে হুগলী এলেও, এরপর তিনি নৈহাটির পাট চুকিয়ে সপরিবারে হুগলীতে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি মালিক কাশেমের প্রাসাদের উত্তরদিকের একটি অংশ হাজীবাবার থেকে ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।

হুগলীতে সে সময় নাট্যচর্চার জোয়ার এসেছিল। বহু ধনী মানুষেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাটকের দল গড়ে তুলে নাট্যচর্চা করতেন। বঙ্কিমের সাহিত্য-প্রতিভা প্রকাশ পাবার পরপরই, এক জনৈক বাবু তাঁকে তাঁর নাটকের দলে যোগ দেওয়ার নিমন্ত্রণ জানান। বঙ্কিম যদিও সেই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন, তবে তিনি নাটক দেখার জন্য নিয়মিত হুগলীতে যাওয়া-আসা করতেন বলে জানা যায়।



বেশ কিছু সাহিত্য ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞের মতে, আনন্দমঠের প্রাণস্বরূপ ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রটি রচিত হয়েছিল, তাঁর জোড়াঘাটের এই বাড়িতেই। আর সেই ধারণা থেকেই চুঁচুড়ার জোড়াঘাট সংলগ্ন এই বাড়িটি ‘বন্দেমাতরম ভবন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে, শ্রীঅরবিন্দের একটি লেখা থেকে জানা যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দেমাতরম’ রচনা করেছিলেন ১৮৭৫ সালে, যা কিনা হুগলী আসার আগেই।

বর্তমানে গঙ্গা তীরবর্তী এই বাড়িতে একটি প্রদর্শনশালা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এখানে। এই বাড়িটি দেখতে এলে বাড়ির ভেতরটা অবশ্যই ভালো করে ঘুরে দেখবেন। বাড়ির ভেতরের জানলা থেকে গঙ্গার দৃশ্য অপূর্ব লাগে। এই বাড়িটিকে "পাতালবাড়ি" বা "চুঁচুড়ার জাদুঘর"ও বলে থাকেন অনেকে।



এবার এই পথ ধরেই এগিয়ে গেলাম হুগলী জেলা সংশোধনাগারের দিকে। ১৮১৭ সালে গড়ে ওঠা এই কারাগারটিও অত্যন্ত প্রাচীন। সুদীর্ঘ লাল পাঁচিল দ্বারা পরিবেষ্টিত এই সংশোধনাগারটি আজও একই ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে।



এর ঠিক উল্টোদিকেই রয়েছে জুবিলী ব্রিজ। চুঁচুড়া ঘাটের পাশেই বিশাল মাঠ আর গাছগাছালি ঘেরা এই জায়গাটি সত্যিই যে কতখানি মনোরম, তা না এলে ঠিক অনুভব করা যাবেনা। মাঠের শেষে রাস্তার ঠিক ওপরেই ঘাসের ওপর দুটি পাশাপাশি কামান রাখা আছে দেখলাম। জানিনা, এগুলির স্থাপনকাল বা অন্যান্য পরিচয় কি!



এই পথ দিয়ে ফেরার সময়, আরও বেশ কয়েকটা প্রাচীন বাড়ি দেখতে পেয়েছিলাম, যার মধ্যে একটি বাড়ির ওপরে লেখা ছিল ভারতীয় রেড ক্রস সমিতি



এছাড়াও রাস্তার ওপর চোখে পড়েছিল একটি প্রাচীন রথ। এগুলির সম্বন্ধে এখনো কোনো তথ্যই জানতে পারা যায়নি।



এরপর আমার গন্তব্য ছিল রামনবমীতলা। এই রামের মন্দিরটি কেবলমাত্র প্রাচীনত্বের দিকে থেকেই বিশেষত্ব লাভ করেনি, এই মন্দিরে রামচন্দ্র উপস্থিত হয়েছেন জগন্নাথ রুপে। যিনি এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন, তিনি বললেন, স্বপ্নাদেশে প্রাপ্ত এই রামঠাকুর পুরী থেকে আনা হয়। এখানে জগন্নাথরুপী রামের পাশে রয়েছে সীতা ও লক্ষ্মণ, আর দু'পাশে ভরত ও শত্রুঘ্ন।


রামনবমীতলার মন্দির


মন্দিরে প্রবেশের সামনেই, নীচে একটি ছোট্ট অংশে অবস্থান করেছেন হনুমান, সেটিও স্থাপিত। এছাড়া রয়েছেন মহাদেব পাশের মন্দিরে। তবে, মন্দিরের মূল বিগ্রহের ছবি তোলার অনুমতি নেই এখানে। প্রতিবছর রামনবমীতে অসংখ্য ভক্তের সমাগম হয় এই মন্দির জুড়ে এবং এর পাশাপাশি মেলাও বসে সমগ্র অঞ্চল জুড়ে।


মন্দিরের অভ্যন্তরের বিগ্রহ


এখান থেকে একটু এগিয়েই রাস্তা জুড়ে বেশ প্রাচীন আর কারুকাজ করা একটি বাড়ি দেখে নেমে পড়লাম। বাড়িটি বর্তমানে ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্কের আওতায়। বাড়িটির নামের ফলকে দেখলাম লেখা আছে “প্রসাদ কুটীর”



এ বাড়ির স্থাপনকাল ১৩২৯ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ। বাড়িটির দু'ধারের গম্বুজ আকৃতির স্থাপত্য ও ছাদের কার্নিশের কারুকাজ এবং বিশেষত লোহার ফটকের নক্সা, সত্যিই বাড়িটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।



এরপর এখান থেকে এগিয়ে গেলাম হুগলী মাদ্রাসার দিকে। এই বিস্তৃত এলাকার একদিকে রয়েছে বিশাল খেলার মাঠ। আর তার আশেপাশের জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে পেল্লায় সব বাড়ি। এর প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো সরকারি কাজে ব্যবহৃত হয় বর্তমানে।


হুগলী মাদ্রাসা


প্রথমে ডাচ, তারপর ব্রিটিশ এবং পরবর্তীকালে ভারতীয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এই সমস্ত আবাসনিক সম্পত্তি। এর মধ্যে হুগলী মাদ্রাসাটি, আগে ছিল একটি ডাচ ব্যারাক। এখন সরকারি পরিচালনায় মাদ্রাসাটি চালানো হয়।



এর পাশেই রয়েছে এক বিশাল বাগানবাড়ি, যেটি এককালে চুঁচুড়ার ডাচ গভর্নরের বাড়ি ছিল।


প্রাচীন কমিশনর হাউসটি স্থাপন করা হয় ১৭৪৪ সালে। পরবর্তীকালে, বাড়িটি ধ্বংসীভূত হবার পর, ব্রিটিশ সরকার এখানেই নতুন বাড়ি গড়ে তোলেন। বর্তমানে এটি বর্ধমানের ডিভিশনাল কমিশনরের বাড়ি হিসেবে পরিচিত।



একটু এগিয়েই রয়েছে বাগানঘেরা বিশাল সার্কিট হাউস



এরপর গেলাম হুগলীর অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হুগলী মহসিন কলেজে। ১৮৩৬ সালে স্থাপিত এই কলেজটিতে, বহুবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন একটা সময়ে। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। কলেজের ভেতরের পরিবেশ খুবই মনোরম। দু'ধারে রয়েছে বিভিন্ন বিভাগের আলাদা আলাদা বিল্ডিং এবং মধ্যিখানের অংশ সুসজ্জিত নানান ফুল ও ফলের গাছ দিয়ে। এই মহসিন কলেজের কাছেই আগে ছিল ফরাসি সৈনিক পেরনের বাড়ি।



কলেজের ঠিক উল্টোদিকের রাস্তাতে অবস্থিত চুঁচুড়া ডাফ হাই স্কুল। এই স্কুলটি হুগলীর অন্যতম প্রাচীন একটি শিক্ষালয়, যেটির স্থাপনকাল ১৮৪৯ সাল। চুঁচুড়া চার্চের প্রথম বাঙালি পাদ্রী রেভারেন্ড পি. কে. চ্যাটার্জি, শিক্ষকতা করতেন এই স্কুলে।


দয়াময়ী কালী মন্দির


তারপর গেলাম আমার সেদিনের শেষ গন্তব্য দয়াময়ী কালী মন্দিরে। নেতাজী সুভাষ রোডের ওপর অবস্থিত এই মন্দিরটির স্থাপনকাল সঠিক ভাবে জানা যায়নি। শুধু মন্দিরের বাইরের নামের ফলকে গোপালরাম পাঠক নামক সেবাইতের নাম লেখা আছে। মন্দিরটি যে প্রাচীন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে, পরবর্তীকালে, এর সংস্কার হবার ফলে প্রাচীন কারুকাজ মুছে চড়া রঙের নকশা ও প্রলেপ পড়ে গেছে মন্দিরের ওপর। মূল মন্দিরের মধ্যে, মা কালীর রূপটি খুবই জাগ্রত। মায়ের হাতের রুপোর খাঁড়া, সোনার জিভ ও কপালের চোখ দেবীর রূপকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।



মূল মন্দিরের পাশে রয়েছে পরপর কয়েকটি শিব মন্দির। গাছপালা ঘেরা শান্ত নিরিবিলি মন্দির প্রাঙ্গন, বিকেলের আলোয় ক্লান্তি এনে দিয়েছিল সেদিন।



সন্ধে হয়ে আসছে, এবার ঘরে ফেরার পালা। তাই সারাদিনের অসংখ্য ভালো মুহূর্তদের স্মৃতি ক্যামেরাবন্দী করে এগিয়ে গেলাম চুঁচুড়া স্টেশনের দিকে।


একটা দিনে, চুঁচুড়ার সবকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন ভালোভাবে দেখা, খুবই কঠিন। প্রতিটা জায়গাকে আলাদা ভাবে দেখতে হলে আর জানতে হলে একাধিক দিনের প্রয়োজন। আজকের আধুনিক চুঁচুড়ার অনেক পরিবর্তন হয়েছে বাকি সব শহরের মতোই। তবে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিকে কিছুটা হলেও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে এবং তাই সাধারণ মানুষের কাছেও এগুলি পরিচিতি লাভ করেছে। এই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ কিছুটা হলেও সচেতন তাঁদের শহর সম্পর্কে। তাই কোনো জায়গায় যাবার সময়, রাস্তাঘাটে কোনো সমস্যায় পড়লে, স্থানীয় মানুষের সাহায্য নেওয়াই যেতে পারে।



❖ জরুরী কথাগুলো:


আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, সারাদিন চুঁচুড়ায় এই সমস্ত জায়গায় ঘোরাঘুরি করার জন্য সেরা বাহনটি হল টোটো। কারো বাইক থাকলে সেটা আলাদা ব্যাপার, তবে চারচাকা গাড়ি নিয়ে এখানে আসলেও, সবকটি জায়গায় গাড়ি পার্কিং করিয়ে ঘুরে আবার গাড়িতে ওঠা, বেশ সমস্যাদায়ক। এছাড়া গাড়িতে যেতে যেতে অনেক সময় কয়েকটা অচেনা জায়গা মিসও হয়ে যেতে পারে, যেটা টোটোর ক্ষেত্রে হবেনা। এই টোটো চুঁচুড়া স্টেশনে নেমেই পাওয়া যায়। তবে একটু ভালোভাবে কথা বলে দরদাম করে নিতে হবে, নাহলে বহিরাগত আগমনকারী দেখে আপনার পকেটটি গড়ের মাঠ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। কোনো এক শীতে অথবা বসন্তের সময়, টোটোয় চড়ে মৃদুমন্দ হাওয়া খেতে খেতে, এভাবেই হয়ত পেয়ে যেতে পারেন, বহু প্রাচীন অদেখা বাড়ির সন্ধান।


চুঁচুড়ায় প্রচুর খাবারের দোকান আছে। তবে, দুপুরের খাবারের ক্ষেত্রে ঘড়ির মোড়ে কয়েকটি দোকান আছে। আমি এর মধ্যে খেয়েছিলাম চুঁচুড়া চার্চের ঠিক পাশেই জনতা হিন্দু হোটেলে। ১৫০ বছরের পুরোনো এই ভাতের হোটেলের খাবার আর পরিবেশ দুটোই বেশ ভালো। দাম তো একেবারেই মধ্যবিত্তের নাগালে। সবথেকে ভালো লাগল যেটা সেটা হলো, এঁদের ব্যবহার এবং খুব তাড়াতাড়ি খাবারের সার্ভিস দেন এঁরা।


চুঁচুড়া যাবার একাধিক ট্রেন আছে হাওড়া থেকে এবং ট্রেনের সংখ্যা অনেক, তাই একটি ট্রেন মিস করলে কোনো ব্যাপারই না। তবে, যত সকাল সকাল পৌঁছনো যাবে, ততই বেশী সময় ধরে জায়গাগুলি দেখা যাবে।


এছাড়া যাদের শিয়ালদহ থেকে যাতায়াত করার সুবিধা, তাঁরা নৈহাটি নেমে নদীপথে নৈহাটি ফেরী ঘাট থেকে লঞ্চে চুঁচুড়া ফেরী ঘাট যেতে পারেন। এই জার্নিটাও বেশ মনোরম।


এছাড়াও চুঁচুড়ায় প্রচুর পুরোনো বাড়ি আছে, যার মধ্যে কিছু বাড়ি এখন সরকারি কাজের আওতার অন্তর্ভুক্ত। তবে, এই সবকটি বাড়িই প্রাচীন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। তাই চুঁচুড়ায় গেলে এই বাড়িগুলি অন্তত একবার দেখে আসা উচিৎ বলে মনে হয় আমার। বলা যায়না, কোনদিন দুম করে সরকার থেকে, এই সমস্ত বাড়িকে ভেঙে নতুন বিল্ডিং গড়ার নির্দেশ আসবে।



 
 
 

Comments


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page