top of page

মাতলা নদীতীরের সাহেববাড়িটা

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Aug 20, 2022
  • 7 min read


তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বুকে আধুনিক বন্দর গড়ার, তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন বাংলাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বাজারের কেন্দ্রস্থলে, টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন সিঙ্গাপুর বন্দরকে মাতলা নদীর তীরে সুবৃহৎ বন্দর গড়ে। তিনি ছিলেন ১৮৫৬ ও ১৮৫৭ সালে পরপর দু'বার মনোনীত পরাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল, ছিলেন ১৮৬২ পর্যন্ত পরপর চার বছর ভারতের ভাইসরয়। তাঁর নামে রাখা হয়েছে কলকাতার একটি অতিব্যস্ত জনপদের নাম, তাঁর নামে নামাঙ্কিত হয়েছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অন্যতম পরিচিত এক সদর এলাকা, তাঁর পেশাগত রাজনৈতিক জীবন থেকে ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত সবকিছুই অতিরঞ্জিত এবং অতিচর্চিত বিগত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসে। তাঁর এক-একটি কলমের আঁচড়ে বদলে গিয়েছে বাংলার শাসন ব্যবস্থার এক-একটি চলমান সিদ্ধান্ত। তাঁর মতো করে আর কোনো ইংরেজ শাসকই সেভাবে চর্চিত হননি, দেশ স্বাধীন হবার এতো বছর পরেও। তিনি আমাদের মাতলা তীরের রাজধানীর অধিকর্তা, তাঁর নাম চার্লস যোহান আর্ল (লর্ড) ক্যানিং। আমরা তাঁকে ও তাঁর সাম্রাজ্যকে "ক্যানিং" বলেই ডাকি।


চার্লস যোহান আর্ল (লর্ড) ক্যানিং


দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার যে দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথটি শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ক্যানিং পর্যন্ত গেছে, তার শেষ স্টেশনটি লাটসাহেবের নামানুসারে রাখা হয়েছিল ক্যানিং। কারণ এই স্টেশনের স্বল্প দূরত্বে ছিল তাঁর একটি পেল্লায় বাসভবন, যদিও আদৌ সে বাড়িতে গিয়ে তিনি কখনো থাকতেন কিনা, সে বিষয়ে কোনো প্রামাণ্য দলিলের খোঁজ পাওয়া যায়নি আজ অবধি, তবু পাশাপাশি ঘটে চলা বেশকিছু ঘটনার প্রমাণ ও বিভিন্ন নথি থেকে মোটামুটি ভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে যে, হ্যাঁ, এটাই লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ি ছিল। আজ এ বাড়ির অবস্থা যে কোনো দেশীয় জমিদারের বাড়ির বর্তমান ভগ্নদশার চেয়েও করুন।



গোটা এলাকা প্রায় ঝিমঝিম করে। বাচ্চারা এ বাড়ির মাঠ জুড়ে খেলাধূলা করে। ছেলেপুলেরা দালানে বসে মোবাইলে গেম খেলে আর নেশা করে। ওদিকে একতলার দুটো খড়খড়ি দেওয়া দরজার ওপারে নিঃশব্দে বছরের পর বছর ধরে দিন কাটিয়ে যান এক পরিবার। বহুবার তাঁরা আবেদন রেখেছিলেন সরকারের কাছে, এ বাড়ির আইনি মীমাংসা করার জন্য। জটলা কাটেনি, নিরাপত্তাও পাওয়া যায়নি তাই। ওদিকে একের পর এক ঝড় এসে বাড়িটাকে ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়েছে একটু একটু করে। শেষবার আম্ফানের পর বাড়ির ছাদের বেশ অনেকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে শুধু আম্ফান নয়, এ বাড়ি এবং সামগ্রিক এই অঞ্চলের ওপর ঝড়ের প্রকোপ পড়া শুরু হয়েছিল সেই ১৮৬৭ সাল থেকে। যে ঝড় কেবল লর্ড ক্যানিংয়ের বন্দর পরিকল্পনার স্বপ্নকে ভেঙে দেয়নি, সঙ্গে ভেঙে দিয়েছিল সদ্য গড়ে ওঠা ক্যানিং শহরকে, একটা গোটা জনবসতি সমেত।



তখন শিয়ালদহ রেলপথের শাখা বেলেঘাটা স্টেশন নামে পরিচিত ছিল। আর এই বেলেঘাটা স্টেশন থেকে দক্ষিণ শাখায় ক্যানিং স্টেশন পর্যন্ত রেলপথ চালু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৬২ সালে। সে সময় ক্যানিং ছিল এ রাজ্যের প্রথম পুরশহর। যে শহরকে আধুনিক বন্দরের রূপ দিতে প্রথমেই ম্যানগ্রোভ বনের অনেকটা অংশ কেটে ফেলছিল লর্ড ক্যানিংয়ের অধস্তন কর্মচারীরা। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন সদর দপ্তর ক্যানিংয়ে। জঙ্গলাকীর্ণ কর্দমাক্ত পথ চেহারা নিয়েছিল নগরকেন্দ্রীক জনপদের। একে একে তৈরি হয়েছিল স্ট্র্যান্ড, হোটেল, শহুরে বাড়ি সবই মাতলা নদীর তীরে।



এই নদীবন্দর গড়ে তোলার উৎসমুখ ছিল খিদিরপুরের কলকাতা পোর্ট। ব্রিটিশ সরকারের গড়ে তোলা এই পোর্ট, আন্তর্জাতিক আমদানি রপ্তানিতে বিপুল ভাবে সহায়তা করলেও, মাঝে মধ্যেই পলি জমে যেত এই বন্দরে, যার যান্ত্রিক নিকাশি ব্যবস্থা সে যুগে তাঁদের পক্ষে করে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। ফলে দক্ষিণের পুরশহর ক্যানিংয়ে বিদ্যাধরী ও মাতলা নদীর অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে এক বিকল্প এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ নদীবন্দর গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন লর্ড ক্যানিং। সেই কথা মতো বন্দর তৈরির বাজেট হিসেবে নির্দিষ্ট করে রাখা হয় আট হাজার একর জমি, তৈরী করা হয় সেই জমির ওপর ২০টি জেটি, যেখান থেকে মাল সরবরাহ করতে ট্রামলাইন পাতা হয় গুদাম ঘর পর্যন্ত এবং সেই গুদাম ঘর থেকে রেললাইন পেতে কলকাতায় মালপত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, এই রেল লাইনই পরবর্তীকালে সরাসরি ক্যানিং সেকশনের রেলপথে যুক্ত হয়ে যায়।


এ তো গেল প্রাথমিক বন্দোবস্তের ঝক্কি। কিন্তু বন্দর চালানো কি মুখের কথা! ফলে খরচ জোগাড়ের জন্য তহবিল গড়া হলো ক্যানিং পুরসংস্থা গঠন করে। টাকা এলো নদীতে চাষ করা স্থানীয় মৎসজীবিদের থেকে, বনজ উৎপাদন এবং বিক্রয় থেকে। পাশাপাশি টাকার জোগাড় করতে উদ্যত হলেন লর্ড ক্যানিংয়ের সঙ্গে মিস্টার ফার্ডিন্যান্ড শীলার। ১৯৬৪ সালে তিনি শেয়ার বাজারের মাধ্যমে মূলধন জোগাড় করতে স্থাপন করলেন পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড। ধীরে ধীরে অর্থ সংস্থান হতে লাগলো। বন্দরে কাজ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জাহাজে চড়ে বৈদেশিক উপনিবেশে ভারতীয় শ্রমিকদের পাঠানো শুরু হলো বিভিন্ন কাজের উদ্দেশে। যেহেতু জোয়ারের সময়ের ওপর নির্ভর করে নদীর জলের নাব্যতা স্থির করা হতো, ফলে ছোট বা মাঝারি আকারের জাহাজ ছাড়া চলাচল সম্ভরপর ছিল না এখানে। এমনই এক শ্রমিক ভর্তি জাহাজ ১৮৬৫ সালের অগাষ্ট মাসে বিদেশে পাড়ি দেবার সময় ভরাডুবি হলো। কে কোথায় তলিয়ে গেল, কিচ্ছু টের পাওয়া গেল না। কত পরিবার শূণ্য হলো! সরকার অবিশ্যি তক্ষুণি ফরমান জারি করেছিলেন শ্রমিক সরবরাহে বিধিনিষেধ আরোপ করে।



কিন্তু নদীর গতিপথের হিসেব মানুষের হাতে নেই। সে তার মতো করে পথ পরিবর্তন করতে করতে এগিয়ে চলে। মানুষের নাগরিক সভ্যতার অভিমুখ, তার কাছে জলের মতোই স্বচ্ছ। তেমনটাই ঠিক হলো এখানে। আমরা অনেকেই জানি, ১৮৬৭ সালের নভেম্বরের দ্য গ্রেট ক্যালকাটা সাইক্লোন সম্পর্কে। যে বিধ্বংসী ঝড় বহু তাবর তাবর অট্টালিকাকেও নিমেষে চুর চুর করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সেখানে ক্যানিংয়ের মতো গ্রাম্য বনাঞ্চলের যে আর তল খুঁজে পাওয়া যাবে না, সে তো বড়ই স্বাভাবিক ব্যাপার।



হলোও ঠিক তাই। একে তো বন্দর তৈরী করার সুবাদে সমগ্র ম্যানগ্রোভ বন কেটে ফেলা হয়েছিল। ফলে ঝড়ের বেগ আটকানোর কোনো সুযোগই পাওয়া যায়নি। নিমেষের মধ্যে গোটা ক্যানিং অঞ্চল সামুদ্রিক নোনা জলের আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে যায়। জেটির ওপর ৬ ফিটেরও বেশী উচ্চতায় জল ঢুকে পড়ে। হিসেব বলে ৯০ জন মানুষ এবং ৫০০ জন গবাদি পশুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে আসল সংখ্যাটা ছিল এর চেয়েও আরো বেশী।


এমন একটা সাংঘাতিক ধাক্কা সামলানো সম্ভব হয়নি কোম্পানির পক্ষে। যদিও প্রাথমিক ভাবে কিছু পরিবর্তন এনে আবার পোর্ট চালু করা হয়েছিল, তিনটি জাহাজও যাতায়াত করেছিল ১৮৬৮ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে, কিন্তু আগের মতো আর তৎপরতা দেখাতে পারেনি সরকার আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে। ক্যানিং ঘোষিত হয়েছিল ‘নিঃশুল্ক বন্দর’ হিসেবে। ধীরে ধীরে লাভের উপায় সংকুচিত হতে হতে ১৮৭০ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নিলো পোর্ট বন্ধ করে দেবার। ওদিকে পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড পট পরিবর্তন করলো দ্য পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড নামক নতুন একটি কোম্পানিতে মুম্বাই শহরে। অতঃপর ক্যানিং বন্দর কাগজে কলমে ইতি টানল।


তবে উল্টোদিকে সুখবর এই যে, পলিজমার সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন যান্ত্রিক উপায় বের করা হলো, ফলে ধীরে ধীরে পথ পরিষ্কার করে নদীপথ সুগম হয়ে উঠতে লাগলো। আর ততোদিনে শিয়ালদহ- ক্যানিং রেলপথও নিয়মিত চালু হয়ে গেল। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা উন্নতি উভয় তরফেই বৃদ্ধি পেতে লাগলো ক্রমশ।



পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর ক্যানিংকে মহকুমা শহরের মর্যাদায় গড়ে তুললেও আজও এই অঞ্চল পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। যদিও বর্তমানে মাতলা নদী সংলগ্ন এই এলাকাকে "সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার" বলা হয়। কিন্তু তা বলে অঞ্চলের প্রশাসনিক উন্নতি খুব যে বিশেষ এগিয়েছে, তা একেবারেই বলা চলে না। এখনো বর্ষা এলে ক্যানিংয়ের মানুষ বন্যার মুখোমুখি হন প্রতিবছর। ভাঙন এই গ্রামের মানুষের কাছে আজও নিয়মিত সংগ্রাম, যার সঙ্গে লড়াই করে প্রতিনিয়ত বাঁচতে হয় এঁদের।


ফটকবিহীন লাটসাহেবের বাড়িটি


এবার আসি লর্ড ক্যানিংয়ের বসত বাড়ির প্রসঙ্গে। ব্রিটিশ আমলে এই বাড়িটি ছিল সরকারের প্রশাসনিক ভবন এবং "পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি"র সদর দপ্তর। ১৮৭২ সালে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যাবার পর যৎসামান্য টাকায় ওই কোম্পানির সঙ্গে সংযুক্ত বাড়িটির তৎকালীন অধস্তন কর্মচারী জিতেন্দ্রমোহন ঘোষ এই বাড়ি এবং এর সংলগ্ন জমিটি কিনে নেন। সেই অর্থে কোনো প্রামাণ্য নথি না থাকলেও সরকারি তরফে বলা হয় যে, বাড়িটি প্রায় ২০০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল। হেরিটেজ কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়িটিকে সংরক্ষণ করে পর্যটন কেন্দ্র বা আজকের ভাষায় হেরিটেজ হোটেল গড়ে তোলবার প্রস্তাবও রাখা হয় ঘোষ পরিবারের তরফ থেকে। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেছে। সংরক্ষণ তো দূরের কথা, নূন্যতম নিরাপত্তাটুকু পায়নি ব্রিটিশ আমলের এই হেরিটেজ বিল্ডিং। বেশ কয়েক বছর আগে মৃণাল সেন বেঁচে থাকতে বাড়িটিতে শ্যুটিং করতে উদ্যত হন। কিন্তু সে কাজ বাস্তবায়িত করা যায়নি নানা গোলযোগে।



ক্যানিং সাহেবের নামাঙ্কিত এ বাড়ির এক একটা খিলানের উচ্চতা অন্ততপক্ষে ১০-১২ ফুট। কড়িকাঠের ছাদের উচ্চতাও প্রায় ১৫ ফুট। মোটের ওপর দোতলা এই বাড়িটিতে সবশুদ্ধ ২৭টা ঘর, যার মধ্যে এই মুহূর্তে মাত্র দু'টো ঘর বসবাসযোগ্য। বাকি সব ধসে পড়েছে একের পর এক দুর্যোগে। সেই দুটি ঘরে থাকেন জিতেন্দ্রবাবুর পুত্রবধূ সবিতাদেবী এবং আরও ২-১ জন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের নিজেদের এই বাড়ি সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেই। রীতিমতো বিরক্ত এবং হতাশাগ্রস্ত প্রত্যেকেই এই বাড়ি নিয়ে। একে তো কোর্টে মামলা চলছে শরীকি ঝামেলার কারণে, অন্যদিকে এতোবার আবেদন করার পরেও সে অর্থে কোনো সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্ষার সময় প্রচণ্ড ঝড়ে, ভয়ে আশঙ্কায় কিভাবে যে এই পরিবার রাত কাটান এখনো, তা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। যে কোনো সময়ে বাড়ির ছাদের যে কোনো অংশের চাঙর খুলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা এখানে প্রবল।



এ বাড়ির গাড়ি বারান্দা সহ লোহার মূল ফটকটির আজ আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না। ব্রিটিশ আমলের ওত পুরোনো দেওয়াল ভেদ করে পুরু ফাটলের আস্তরণ দেখা যায় বাড়ির যত্রতত্র। সঙ্গে রয়েছে অশ্বত্থ আর বটবৃক্ষের সহবাস, যা মূল থেকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চায় যে কোনো পুরোনো বাড়ির অস্থি মজ্জায়।



তবে আজ ভগ্নদশা হলেও, এক সময় এ বাড়িতে মণিমুক্ত কম ছিল না। ২০০৪ সালের ১২ই অগাষ্ট "দ্যা হিন্দু" পত্রিকার একটি প্রতিবেদন বলছে, ব্রিটিশ ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিংয়ের এই বাড়ি থেকে সন্ধান পাওয়া গেছে বহু দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য সামগ্রীর, যার মধ্যে রয়েছে লন্ডনের লরেন্স অ্যান্ড ম্যায়োর তৈরী পিতলের দূরবীন, কম্পাস, ব্রিটিশ আমলের আসবাবপত্র, বেলজিয়ান গ্লাসের ড্রেসিং টেবিল সহ আরো বহু প্রাচীন জিনিসপত্র। কেবল ঘোষ পরিবার নয়, খবর পাবার পর আশপাশের স্থানীয় লোকজনও এই সব দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী নানান ভাবে উদ্ধারের চেষ্টা করেছে। বলা যেতে পারে, যার ভাগে যা জোটে এই উদ্দেশে প্রত্যেকেই বিস্তর খানাতল্লাশি চালিয়েছে এই বাড়িতে। জানা গেছে, একসময় নাকি ব্যবহারযোগ্য ভূগর্ভস্থ তল ছিল এ বাড়ির নীচে, যা বহু বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে, এখন সামনে থেকে বাড়ি ঘুরে দেখলেও ভূগর্ভের তল বোঝা সম্ভব হয়না।


সাহেবি দরজার হাতল


সবকিছু না থাকার মধ্যেও একটি সাহেবি বৈশিষ্ট্য এখনো চোখে পড়বে এ বাড়ির দরজায়। তা হলো দরজার ভেতর দিকের হাতল, যাতে রয়েছে পেতলের হাতের ছাপ, এবং মুঠো করে হাতল টানার একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।



ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, এই মূল সদর দপ্তরটি ছাড়াও এই অঞ্চলে লর্ড ক্যানিংয়ের আরো একটি নিজস্ব সম্পত্তি ছিল, যেখানে লেডি ক্যানিং প্রায়শই এসে উঠতেন ছবি আঁকবেন বলে, সেই বাড়িটিও পরবর্তীকালে ঘোষ পরিবার কিনে নেন। যদিও সেই বাড়ির আর কোনো অস্তিত্ব নেই আজ। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বাড়িটি ঘোষ পরিবার কর্তৃক বহু আগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের দায় সামলাতে নিরুপায় হয়ে সে বাড়ির ইঁট বিক্রি করে টাকার যোগান দিতে হয়েছে তাঁদের। এতো কিছু ঘটার পর ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন থেকে 'হেরিটেজ' তকমা দেওয়া হয় বাড়িটিকে। কিন্তু এ তকমা সে অর্থে বাড়িটির কোনো সামগ্রিক উন্নতিসাধনে আসেনি।


সূর্যাস্তের মুহূর্ত মাতলার তীরে


মাতলা নদীর নিরবধি গতিপথ সে যুগে আটকাতে পারেনি কেউ। নিতান্তই স্বাভাবিক ভাবে বয়ে আসা প্রকৃতির প্রতিকূল দশার স্বীকার হয়েছে বহু বহু সাধারণ গ্রামবাসী। রক্ষা করা যায়নি যেমন তাঁদের, তেমনই ক্যানিং সাহেবের স্বপ্নের বন্দরও গড়ে ওঠেনি। আজ নদীর চর ধরে হাঁটলে সেসবের ভগ্নাবশেষও খুঁজে পাওয়া যায় না।



তবে চাইলে আটকানো যেতে পারতো ক্যানিং সাহেবের বাড়ির ভাঙন। যাঁর নামে আজও একটা বৃহৎ সদর এলাকা চিহ্নিত হয়, কলকাতার রাস্তা় থেকে শুরু করে রেলপথের নাম সবকিছুই আজও যাঁর একটি নামে সকলেই চিনতে পারে, যে সাহেবপত্নীর একবার ভালোলাগায় মিষ্টির নাম লোকমুখে হয়ে যায় 'লেডিকেনি', যাঁর শহীদ বেদী আজও একটি দর্শনীয় স্থান পশ্চিম বাংলায়, তাঁর বাড়িকে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি দিয়েও কেন সংরক্ষণ করে তার পুনঃজীবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলো না এখনো, তা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন থেকে যায়। থেকে যায় বিতর্ক, দোষারোপ, হা হুতাশ ইত্যাদিও। কিন্তু এসবের মধ্যে পড়ে ভুক্তভোগী হয়ে যান কিছু মানুষ, এবং একটা সময়ের ইতিহাসের দৃশ্যমান সম্পদ। যা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে গর্বের ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েও পারেনি।



তবে আবারও আশাবাদী হয়েই শেষ করবো প্রতিবারের মতোন। "একটা ভাঙা বাড়ি কি করতে দেখতে যাবো?" এই চিন্তাভাবনা নিয়ে অনুগ্রহ করে ক্যানিংয়ে যাবেন না। যেতে হলে বর্তমান ইতিহাসকেই দেখতে যান। কে বলতে পারে যত বেশী মানুষ যাবেন, তত বেশী করে পরিচিতি পেতে পেতে জনপ্রিয়তার খাতিরে আবার নতুন পরিচয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে না ভবিষ্যতের এই 'ক্যানিং হাউস'?



 
 
 

Comentários


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page