top of page

অপুর বাড়ির পথ

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Mar 16, 2021
  • 5 min read

প্রথম পর্ব


কিছু কিছু জায়গা এমন হয়, যেটা বাস্তবের চোখে দেখার আগেই, কল্পনার চোখ দিয়ে অনেকদিন আগেই পৌঁছে যাওয়া যায়। মনে করা যাক, ছোটবেলার গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরবেলা, বারান্দায় বসে বসে “চাঁদের পাহাড়” পড়বার দিনগুলোর কথা, কিংবা অ্যানুয়াল পরীক্ষার শেষে চিলেকোঠার ছাদে বসে “আরণ্যক” পড়বার মুহূর্তগুলো। মনে মনে তো কবেই ধূসর পাহাড় আর শালবনে ঘেরা ধলভূমগড়ের সদর, ঘাটশিলায় পৌঁছে গেছি। কতবার ভরদুপুরে অরণ্যানীর অন্তরালে শুয়ে থেকেছি। নাম ধরে ডেকেছি কত আদিবাসী মেয়েদের! মহুয়ার গন্ধ পেয়েছি মনে মনে।



বাঙালীর বেড়াতে যাবার চিরকালীন আরামদায়ক সব জায়গাগুলোই বড় হবার পর গেছি। তবে, যাওয়া মাত্রই বন-পাহাড়ের আনাচ-কানাচ থেকে ছোটবেলার পড়ে আসা কল্পনাময় স্মৃতিগুলো হাতড়াতে থেকেছি। কিছু খুঁজে পেয়েছি, কিছু পাইনি। যা পেয়েছি, তা তো সদা আনন্দময়। তবে যা পাইনি, সেগুলোকে কল্পনার মজবুত প্রাচীর ভেদ করে, বাস্তবের দুনিয়ার অভিযোজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে ফেলতে চাইনি।



সবকিছুই যেমন বদলায়, ঘাটশিলাও তেমনি ভাবে বদলেছে। রাজনীতির রুঢ় আঁচড়, বাঙালীর হাওয়া বদলের চিরন্তন চেনা পরিবেশটাকে খানিক এলোমেলো করে দিয়েছে। বাঙালী পাড়াগুলো থেকে থেকে ভরে উঠেছে, হিন্দী ভাষাভাষী মানুষের আগ্রাসনে। যে প্রাচীন জনজাতির থেকে, এই ঘাটশিলার লৌকিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তারাও এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের শিকড়টাকে আগলে রাখতে পারেনি বেশীদিন। বাঙালী জাতি যে কীরূপ অসহায় তাও পদে পদে টের পাওয়া গেছে কিছু কিছু অঞ্চলভেদে।



শান্তিনিকেতন আর পুরুলিয়ার পর বসন্তের হাওয়া বাঙালিকে যেখানে অবধারিত ভাবে টেনে নিয়ে যায়, তার নাম ঘাটশিলা। বাঙালীর এককালের ব্যামো সারাবার ঠিকানা, যেখানে টুক করে “ওই একটু চেঞ্জে যাচ্ছি” বলে চলে যাওয়া যায়। আমি অবশ্য ফাগুনী পূর্ণিমা রাতে পলাশের খোঁজে গেছিলাম। যদিও পলাশ পাইনি, তবে পেয়েছি ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলা কিছু স্মৃতিদের। আজ সে গল্পই বলব...



আমি যেখানেই যাই, আকশ মেঘলা হয়ে বৃষ্টি আসে, সেটা বছরের সে সময়ই হোক না কেন। তাই এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। মেঘের গুরুমগুরুম শব্দ আর থৈথৈ জল পেরিয়ে কাদা প্যাচপ্যাচে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছলাম। তারপর সেই চিরাচরিত ইস্পাতের জংধরা উইন্ডো সিট। পথ যত এগোতে লাগল, মেঘ তত ঘনিয়ে এল। আমি ভাবলাম, এবারের যাত্রা শুধু মাটিই নয়, হতে চলেছে কাদামাটি।



ঘাটশিলা যখন নামলাম, তখন সদ্য বৃষ্টিটা থেমেছে। ষ্টেশন চত্বর জলে থৈথৈ করছে। ব্যাগপত্তর নিয়ে বেরিয়ে অটো ধরে সোজা চলে গেলাম হোটেল সানন্দায়। হোটেলে লোক গিজগিজ করছে। আগে থেকে বলা ছিল বলে, ছাদের কোণার দিকে একখানা আঁটোসাঁটো ঘর পেয়েছিলাম। দুর্দিনের বাজারে এই রক্ষে! হালকা করে জিরিয়ে নিয়ে স্নান সেরে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আকাশের আলোকিত মেজাজে সূর্যরশ্মি তখন ঝলকানি দিচ্ছে রাস্তাঘাট জুড়ে।


ফুলডুংরি


প্রথমে খাওয়াদাওয়া সেরে তারপর, হাঁটতে হাঁটতে ফুলডুংরি টিলায় পৌঁছলাম। কখনো রোদ, কখনো ছায়াময় পথের আশপাশ ঘেঁষে টিলার ওপরে উঠলাম। মাঝে একটা গোল ছাউনি মত জায়গায়, হাঁড়ি ভর্তি ছোট ছোট মাছ নিয়ে স্থানীয় লোকজন কীসব কথা বলছে নিজেদের মধ্যে! টিলার চৌহদ্দিটা অরণ্যে ঘেরা। একটু নিচু হয়ে দেখলে ছোটবেলায় খেলার মাঠে, ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশ দেখার কথা মনে পড়ে যায়।


গাছের বন্ধু


এখান থেকে বেরিয়ে টিঙ্কুদার অটোতে চেপে বসে চললাম নতুন রঙ্কিণী দেবীর মন্দিরে। বেশ বড় জায়গা নিয়ে এই মন্দির। সামনে রয়েছে হাঁড়ি কাঠ। অষ্টমী ও নবমীতে এখনো মোষবলি চলে এখানে।


নতুন রঙ্কিণী দেবীর মন্দির


মূল মন্দির জাদুগোড়ায় হলেও, কোন এক বিশেষ কারণবশত, এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা জগন্নাথ পরবর্তীকালে নতুন রূপে রঙ্কিণী দেবীর মন্দির স্থাপন করেন তৎকালীন শাসন কেন্দ্র ঘাটশিলায়।



এখানে দেবী অষ্টভূজা কালী রূপিণী। দুর্গাষ্টমীর আগের জিতাষ্টমীতে এখানে প্রতি বছর উৎসব পালিত হয়।


এখান থেকে বেরিয়ে চিত্রকূট পর্বতের দিকে যেতে যেতে নীল আর সবুজে মেশা সুবর্ণরেখার গলিপথ চোখে পড়ল। সেখানে তখন মেয়ে-বউদের স্নানের পর্ব চলছে।


চিত্রকূট পর্বতটা হিমালয় পর্বতের থেকে কোন অংশে কম রোমাঞ্চকর নয়। চওড়া রোদের পারদ এড়িয়ে, লালমাটির খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা নুড়ি পাথর সামলে তারপর চকচকে সাদা রঙ করা পর্বতশৃঙ্গে পৌঁছতে হয়।


চিত্রকূট পর্বত


চারপাশে হু হু করে বসন্তের বাতাস বয় আর মহাদেবের ভক্তদের শৈল্পিক ক্রিয়াকলাপে চিত্রকূট হঠাৎ করে কৈলাস কৈলাস মনে হয়।


পাহাড়ের ওপরে শিব মন্দির


ডানদিকের পাহাড়টার ওপর উঠছি, এমন সময় কু ঝিকঝিক একটা শব্দ। ওপারে ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন চলেছে সশব্দে। এক নিমেষে কৈলাস কখন যে হঠাৎ করে বিভুতিবাবুর অপুর রেলগাড়ি দেখার বিহ্বল দৃষ্টির কথা মনে করিয়ে দিল, সেটা বোঝার আগেই ট্রেনটা চলে গেল চক্ষের নিমেষে।



উদাসী হাওয়ার পথ বেয়ে বেয়ে আমরাও নেমে এলাম স্মৃতির সরণী ধরে।



এখান থেকে বেরিয়ে রাজবাড়ি, যা ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে এখন। কবেই হাতবদল হয়ে মাড়োয়ারিরা কিনে নিয়ে ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দিয়েছে! সামনের ভাঙ্গা ঘরগুলোয় থাকে স্বামী-স্ত্রী ও ছোট্ট মেয়ের পরিবার। এরাই এখন এ বাড়ির কেয়ারটেকার। রাঁধে, খায়, টুরিস্ট এলে ঘুরিয়ে দেখায়। এসব করেই সংসার চলে। মালিকরা আর ক’ পয়সা দেয়!


পুরোনো রাজবাড়ি


একরত্তি মেয়ে আর মায়ে মিলে গোটা বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাল। কোথাও রয়েছে পাতকুয়ো, কোথাও রয়েছে ভাঙ্গা বাথটব। দালান, অন্দরমহল, বাহিরমহল আলাদা করে চেনবার উপায় নেই তেমন।


আলো আঁধারি অন্দরমহলে


দোতলার একটা ঘরে শুনলাম আগে নাকি ফাঁসি দেওয়া হত। এখনও সেখানে ওপর থেকে একটা লম্বা দড়ি ঝলে, তবে তাতে ভারী বস্তা বাঁধা, সেটাই নাকি একরত্তি মেয়েটার ঢিসুম-ঢিসুম করবার পাঞ্চিং ব্যাগ। সবশেষে উঁচু-উঁচু সিঁড়ি বেয়ে ন্যাড়া ছাদে পৌঁছলাম। ইতিহাস ধুয়ে মুছে গেলেও, প্রাকৃতিক তারুণ্য এখনো উজ্জ্বলতায় ভরিয়ে রেখেছে চারপাশটাকে।



রাজবাড়ির পর যখন সুবর্ণরেখার তীরে গেলাম, সূর্যের তীক্ষ্ণ তাপে শান্ত সুবর্ণরেখা তখন সোনার মতই চকচক করছিল। একদল স্কুলের ছেলেপুলেরা এক্সকারশানে এসেছে দিদিমণিদের সঙ্গে। তপ্ত নদীর ক্লান্ত বেলায় সে জলে ডুব দিয়ে যে কী আনন্দ, তা বোধহয় তারাই জানে।


সুবর্ণরেখা, ওপারে মন্দির


এরপর বড় ক্লান্ত লাগছিল। প্রখর রোদের তাপে গা-হাত-পা জ্বালাজ্বালা করছিল। “জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই”, ভাবতে ভাবতে রামকৃষ্ণ মিশনের পথে এগোলাম।



পৌঁছে মঠের শান্ত ছায়ায় খানিক জিরিয়ে নিলাম, বাগানের ফুলগুলোর সাথে। দুপুর সাড়ে তিনটে বাজতেই খুলে গেল মন্দিরের দরজা। সেই চেনা ধুপ-ধুনোর গন্ধ, নীরবতা মিশে আছে ফুলেদের ধারে কাছে।



এখান থেকে বেরিয়ে বিভূতিভূষণের বসত বাটির দিকে এগোলাম। একটা সরু রাস্তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে অপুর বাড়ির পথ।



“গৌরিকুঞ্জ” নামটি লেখক তাঁর প্রথম স্ত্রীর নামানুসারে রেখেছেন। ভেতরে রয়েছে কাচের দরজা আঁটা লেখকের ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী। এছাড়া রয়েছে কিছু বই আর চিঠিপত্র।


পথের পাঁচালির পাণ্ডুলিপির অংশ


পুরো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ আর যা কিছু টুকিটাকি পড়ালেখার কাজ, তার বেশীরভাগটাই অনুদানের ওপর ভরসা করে চলছে। বাগানের শেষ মাথায় রয়েছে অপুর পাঠশালা।



ছোটখাটো একখানা মঞ্চের ওপর এখানে প্রতি রবিবার সকালবেলা স্থানীয় দুস্থ ছেলেমেয়েদের নিশুল্ক বাংলা পড়ানো হয়। গোটা ঘাটশিলা অঞ্চলটাই যেখানে হিন্দী আগ্রাসনের স্বীকার হয়ে উঠেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের তাগিদে মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার এই প্রয়াস, আমাকে আবার অবাক করে দিল।


গৌরিকুঞ্জ থেকে বেরিয়ে হিন্দুস্থান কপারের ধসে যাওয়া কারখানাগুলো পেরোতে পেরোতে রাতমোহনার দিকে এগোতে লাগলাম।


হিন্দুস্থান কপার লিমিটেড


বিশ্বের দ্বিতীয় গভীরতম তামার খনি, এককালে কী সুনাম-ই না ছিল! এখন সেসব পরিবর্তনের বাতাসে চিমনির ধোঁয়ার সাথে উবে যাচ্ছে রোজ, অতীতের হাত ধরে সুবর্ণরেখার ওপার থেকে।



রাতমোহনার পাড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে, বৈকালিক চা-টা সেরে, নেমে গেলাম নদীর কাছে। মোহন কুমারমঙ্গলম সেতুর ওপর সুবর্ণরেখার চর বরাবর যতদূর চোখ যাচ্ছিল, ততদূর ছেয়ে আছে হলদে পশ্চিমী আলোটা তখন।



শেষবেলাতেও নদীর উচ্ছল মেজাজটার সাথে পাল্লা দিচ্ছে সে। একটা দিকে নীলচে জলের ফাঁকে ফাঁকে, ছোট বড় ঢিবির আনাচে-কানাচে ঘাসজমি তৈরি হয়েছে। আরেকটা দিক দূর থেকে ঝর্নার মত দেখতে লাগে, যার উৎস সন্ধান করা বড়ই কঠিন মনে হয় কাছে গেলে।


জংলি মোহনা, নীলস্রোতে


এসব পার করে এগিয়ে গেলাম সামনের গভীর জলরাশির দিকে। মাঝখানটা জুড়ে একটা উঁচু পাথরের ওপর বসে দুজন স্থানীয় লোক মাছ ধরছে, আর সামনে গিজগিজে আমুদে লোকজন, হো হো শব্দে জলে নামার উচ্ছাস ও উত্তেজনা প্রকাশ করছে একসাথে।


খানিক জল পেরিয়ে একটা ছোট পাথরের ওপর বসলাম। পূব দিকে তখন নদী আর আকাশের রঙ মিশে মিলে হয়ে উঠেছে নীলাম্বরী, ওদিকে পশ্চিমে একটু একটু করে সারাদিনের আলোমাখা গন্ধগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে সুবর্ণরেখার জলে।



এই পলকা সময়টাকে আটকে ইচ্ছে করে আমার বরাবর। প্রতিটা দিন সেই একই সূর্য, পাহাড়-নদী-বনানী ভেদে কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে অস্তগামী হতে পারে, তা বোধহয় প্রতিবার আলাদা করে না দেখলে উপলব্ধি করা যায়না। মায়া পড়ে যায় বড্ড।


রাতমোহনায় অস্তগামী

মেঘ ঘনিয়ে সন্ধ্যে নামে ঘাটশিলা শহর জুড়ে


সেদিন বাড়ি ফিরে ক্লান্তি নেমে এসেছিল শরীর জুড়ে। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে নিয়ে শোবার তোড়জোড় করছি এমন সময় মেঘ গর্জিয়ে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। মনটা আবার কু গাইতে লাগল আগামীকালের চিন্তায়। টানা দু ঘণ্টা বৃষ্টির জেরে দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে জলটল ঢুকে তখন একাকার অবস্থা। কোনরকমে সামাল দিয়ে নিদ্রায় গেলাম সে রাত্তিরে।


চলবে...

 
 
 

Comentários


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page