top of page

উত্তরের পথে পথে

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Feb 7, 2021
  • 4 min read

প্রথম পর্ব।।



খুব বেশী কিছু চাইনি জীবনে, শুধু মেঘ আর রোদ্দুরে মাখামাখি করা একটা আস্ত গোটা দিন ছাড়া। কতবার ভেবেছি ট্রেন ধরে একা একা পালিয়ে যাব, মেঘ-পাহাড়ের দেশের ছোট্ট একটা গ্রামে। তবে ইচ্ছের সঙ্গে যে ধৈর্যের একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে, সেটা যতক্ষণ না নিজের জীবনে টের পেয়েছি, ততক্ষণ আর “বেরিয়ে পড়া” টা সত্যি সত্যি হয়ে ওঠেনি। আমার আজকের গল্পের অনেকটা জুড়েই রয়েছে এই বেরিয়ে পড়াটা, যেটাকে সম্বল করেই আমার বেঁচে থাকবার ইচ্ছেটা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে, আর এই ইচ্ছেটাকে জীবিত রাখার জন্য দরকার প্রাণ ভরা অক্সিজেনের, আর অক্সিজেন মানে তো, কু………ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক………



পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন…আহা! ভাবলেই পিঠটা এখনো হালকা ব্যথা ব্যথা করে… আমি তো জীবনেও ট্রেন ধরবার ক্ষেত্রে কোন স্টেশন ট্যাক্সি বা ওলা, উবেরে যাইনা, যাই মেট্রো, বাস আর লোকাল ট্রেনে, কারণ, আমার সফরটা বাড়ি থেকে বাইরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায়। যাইহোক, শিয়ালদা অবধি ওই পিঠের বস্তাটাকে বয়ে নিয়ে যেতে যেতে যে অনুভূতি হয়েছিল, তা থেকেই মনে পড়ে গেছিল আর কি পিঠের ব্যথার কথাটা। তারপর, বোঁচকা-বুঁচকি এদিক-ওদিক সাইড করবার পর, ট্রেনটা যখন ফাইনাল হুংকার দিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল, তখন মনে হল যাক, “সত্যিই যাচ্ছি তাহলে!”...তারপরের গল্প থুরি এপিসোডগুলো তো আপনাদের সকলেরই জানা। থেকে থেকে হা হা, হো হো, হ্যাঁচ্চো, খকখক, সরে এসো না, উফফ! কি গন্ধ!, নেটওয়ার্ক নেই, দাদা লাইটটা অফফ করুন, ফোনের সাউন্ডটা কমান এবং ফাইনালি, সেই অসীম সাড়াজাগানো শব্দের বিচ্ছুরণ... ঘহহহহররররররররর...ফু......ঘহহহহররররররররর। এটাও যখন কানে সয়ে গেল, তখন একটু ঘুম এলো এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই...বিপুল করতালির মাধ্যমে একদল উৎসাহিত জনগণ খিলখিল করতে করতে... “এনজেপি এসে গেছি, এনজেপি এসে গেছি, খুব ভালো ঘুম হয়েছে... ...এঁহে, এঁহে”। আমি এসব শোনার পরেও দাঁতে দাঁত আর কানে হাত চেপে, নিজেকে বোঝালাম, এখনো কোচবিহার আসতে বেশ খানিকটা দেরী, সুতরাং, এরা নেমে গেলে আমি আবার ঘুমোতেই পারি। হ্যাঁ, তারপর আমি ৯টা অবধি ঘুমিয়েছিলাম। আপার বাঙ্ক থেকে নেমে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি সকালটা মেঘলা, ট্রেন তখন ধূপগুড়ি ছাড়িয়ে গেছে।



কোচবিহার নামক এই গোটা জেলাটার জন্মই আসলে একটি রাজনৈতিক চুক্তির ফলে। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে কোচবিহারের রাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যার ফলে কোচবিহার ব্রিটিশদের অধীনত্ব লাভ করে। এরপর ১৭৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে রাজ্যটি “কোচ-বিহার” নামে পরিচিত হয় এবং এর রাজধানীর নাম হয় “বিহার ফোর্ট”। প্রসঙ্গত বলা উচিৎ, “কোচবিহার” শব্দটির অর্থ হল “কোচ জাতির বাসস্থান”। কোচবিহার গেজেট অনুযায়ী, মহারাজার আদেশ অনুযায়ী রাজ্যের সর্বশেষ নামকরণটি হয় “কোচবিহার”।


কোচবিহার রাজবাড়ির সিংহদুয়ার


ট্রেন থেকে নেমে টোটো ধরে হোটেল পূর্বাচল। হোটেলটা রাজবাড়ির একদম কাছেই। বেশী সময় নষ্ট না করে ক্লান্ত শরীরটাকে একটু রিফ্রেশ করে একবারে বেরিয়ে পড়লাম ঘোরাঘুরির উদ্দেশ্যে।



রবিবার, ছুটির দিন। শহরের ঘুম সেভাবে ভাঙ্গেনি তখনো। বেশীরভাগ দোকানপাটই প্রায় বন্ধ। বেশ খানিকটা হেঁটে একটা খাবার দোকান পেলাম, সেখানে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে চললাম কোচবিহার রাজবাড়ির দিকে। রাজবাড়ি তখনও কুয়াশায় ঢাকা।



টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করার পর মনটা কেমন জানি ভিক্টোরিয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। দুটিই ব্রিটিশ আমলের সৃষ্টি কিনা!


কোচবিহার রাজবাড়ির বাহিরাংশ


ইতিহাস জানান দেয়, ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদের আদলে এই রাজবাড়িটি তৈরি হয়েছিল। এটিকে অনেকে ভিক্টর জুবিলী প্যালেসও বলে।


রাজবাড়ির অভ্যন্তরে

মহারাণী গায়েত্রি দেবী


এক্কেবারে ক্লাসিকাল ইউরোপিয়ান স্থাপত্যে মোড়া দোতলা একটি প্রাসাদ, যেখানে শয়নকক্ষ থেকে বৈঠকখানা, ডাইনিং হল থেকে বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার, তোষাখানা, লেডিজ গ্যালারি এবং দোতলায় বিভিন্ন দুষ্প্রাপ সামগ্রী ও অ্যান্টিক আসবাবও প্রদর্শনীর জন্য সাজিয়ে রাখা রয়েছে।


সংগ্রহশালার দ্রষ্টব্য মূল্যবান সামগ্রী



সমগ্র রাজবাড়ি ঘুরতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল।


মদন মোহন মন্দির


তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে একটা টোটো ধরে গেলাম মদন মোহন মন্দির। কোচবিহার জেলার মূল কেন্দ্রে অবস্থিত এই মন্দিরের স্থাপনকাল ১৮৮৫-১৮৮৯ সালের এর মধ্যে।



এখানে মদন মোহনের বিগ্রহের পাশাপাশি, কালী, তারা এবং মা ভবানীর বিগ্রহও উপস্থিত। রাসের সময় গোটা প্রাঙ্গন জুড়ে বিশাল উৎসব ও মেলা বয়সে।


জেলা শিশু সুরক্ষা দপ্তরের অফিস বর্তমানে এই বাড়িটি

মুস্তাফি হাউস নামে পরিচিত এই বাড়িটি


পথে যেতে যেতে বেশ কিছু পুরনো সরকারি অফিস ও পুরনো বাড়ি চোখে পড়ল, যা থেকে বোঝা গেল, শহরে এখনো খুঁজেলে বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে।


বড়দেবী মন্দির


এরপর গেলাম বড়দেবী মন্দির। তখন বিকেলের রোদ পড়েছে লাল রঙের মন্দিরের ওপর। এই মন্দির জুড়েও ইউরোপিয়ান স্থাপত্যেরশৈলী রয়েছে। মন্দিরের ভেতরে আছেন স্থাপিত দুর্গা প্রতিমা। প্রতি বছরই দুর্গাপুজো হয় এখানে।


মধুপুর ধাম


সবশেষে পৌঁছলাম মধুপুর ধাম মন্দিরে। ১৪৮৯ সালে শঙ্করদেব শেষবারের মত যখন কোচবিহারে আসেন, কোচবিহারের রাজা নর নারায়ণ তখন তাঁকে অনুরোধ করেন, নতুন বৈষ্ণব দর্শন শেখাবার জন্য, সেই উদ্দেশ্যে ষোড়শ শতাব্দীতে মধুপুর ধাম নির্মিত হয়।


মধুপুর ধামের অন্দরে

উপাসনা গৃহ


এই ধর্মীয়স্থানটি আচার্য শঙ্করদেবের ভক্তবৃন্দদের পূজার্চনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যও জনপ্রিয়।

মধুপুর ধাম থেকে বেরিয়ে পাতাবিহীন গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখি, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো দুধারে সরাতে সরাতে, আকশটা কখন ঘন নীল হয়ে গেছে...


নীল আলো কে ছড়ালো


ফেরার সময় অন্ধকার নামতেই দেখি, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আমি থাকব অথচ বৃষ্টি আসবেনা, এই দুটো বিষয়ের সমাপতন না হলে আমার বেড়াতে যাওয়াটা ঠিকঠাক জমে ওঠেনা। ফিরে এসে, খাওয়াদাওয়া সেরে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় জাস্ট এলিয়ে দিলাম। তারপর এক নিমেষে পরের দিন চোখ খুলে দেখি একটা হলুদ সকাল এসে গেছে।


বানেশ্বর শিব মন্দির


সেদিন আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল কোচবিহার শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বানেশ্বর শিব মন্দির, যেখানে পর্যটক মূলত কচ্ছপ দেখার উদ্দেশ্যে যায়। মন্দিরের দশ ফুট নীচে ভু-গর্ভে অবস্থিত শিবলিঙ্গটি। প্রধান মন্দিরের পাশে আরেকটি মন্দির আছে, যেখানে একটি অর্ধনারীশ্বরের মূর্তি স্থাপন করা আছে।



মদন চতুর্দশী ও দোল পূর্ণিমার দিনে এই মূর্তিটি কোচবিহারের মদন মোহন মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাই মন্দিরের এই শিবলিঙ্গটিকে চলমান বানেশ্বর নাম দেওয়া হয়েছে। মন্দির চত্বরের ভেতর একটি বড় পুকুর রয়েছে। সেখানেই খানিকক্ষণ ওত পেতে থাকলে গুটিকয়েক কচ্ছপের আনাগোনা দেখা যেতে পারে।


বেচারা উঁকি দিয়েছে


শিব চতুর্দশীতে এখানে এক সপ্তাহ ব্যাপী ব্যাপক মেলা বসে। এরপর সামনের দোকান থেকে প্রাতরাশ সেরে চটপট গাড়িতে উঠে প্রকৃতির হাতছানিতে সাড়া দিতে এগিয়ে গেলাম আলিপুরদুয়ারের দিকে।



চলবে...

 
 
 

Commentaires


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page