উত্তরের পথে পথে...২
- Shrabanti Mitra
- Feb 13, 2021
- 7 min read
Updated: Feb 17, 2021
দ্বিতীয় পর্ব

দুপাশে চা বাগান, আর খানিকটা দূরে দূরে ছোট ছোট ঝুপড়ি, আধো আধো মেঘ আর হালকা রোদের ফাঁকে হুশ করে বক্সা টাইগার রিসার্ভের ভেতরে ঢুকে পড়ে, পৌঁছে গেলাম রাজাভাতখাওয়া মিউজিয়াম।

রাজাভাতখাওয়া মিউজিয়াম
রাজাভাতখাওয়াও আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান যেখানে, রাজায় রাজায় সন্ধি হয়েছিল। বক্সা অঞ্চল সংলগ্ন সমতল ভূ-ভাগ কেন্দ্রীক অশান্তির জেরে কোচবিহারের রাজা ধৈর্য্যেন্দ্রনারায়ন ভুটান সেনাপতি পেনশু তোমা-এর হাতে বন্দী হন। বন্দী রাজাকে প্রথমে বক্সা ও পরে তৎকালীন ভুটানের রাজধানী পুনাখাতে বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু ১৭৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাবাহিনীরা কোচবিহারের সমস্ত ভুটানি সেনাদের ঘাঁটি ভেঙে দেয় এবং ভুটিয়া মুক্ত করতে চায় কোচবিহারকে। যুদ্ধশেষে, রংপুরের কালেক্টর পারলিং ভুটানের রাজাকে চিঠি লিখে জানান রাজা ধৈর্য্যেন্দ্রনারায়নকে মুক্তি না দিলে ইংরেজ সৈন্যরা ভুটান রাজধানী দখল করবে। যার ফলে তিশু লামার মধ্যস্থতায় ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির সঙ্গে ভুটানের সন্ধি হয় ১৭৭৪ সালের ২৩শে এপ্রিল। এরপর সন্ধির শর্তানুসারে রাজা ধৈর্য্যেন্দ্রনারায়ন ভুটান থেকে মুক্তি পেয়ে বক্সার পথে কোচবিহারের দিকে যান। রাজার মুক্তির আনন্দে রাজপুরুষগণ রাজাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যায় বক্সার দিকে এবং এইখানে চেকাখাতার কাছে রাজার প্রথম অন্নগ্রহণের ব্যবস্থা করেন। বহুদিন পর স্বদেশে ফিরে এখানেই ভাত খান রাজামশাই এবং এরপর থেকেই লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে এই স্থানের নাম হয়ে ওঠে “রাজাভাতখাওয়া”।

বনদপ্তর দ্বারা পরিচালিত এই রাজাভাতখাওয়া মিউজিয়ামে সংগৃহীত আছে নানাধরণের বন্যপ্রাণীর প্রতিকৃতি, জীবাশ্ম, সাজানো রয়েছে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ সারি সারি বাক্স ভরা। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির অর্কিড। বন্য প্রকৃতিকে কৃত্রিম রুপে সাজিয়ে তোলা হয়েছে গোটা সংগ্রহশালা জুড়ে।

প্রকৃতির একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, যেটার ঘ্রাণ ভরপুর ভাবে আস্বাদন করা যায়, যখন আমরা অরণ্যের কাছাকাছি পৌঁছই। একটু আগেও হয়ত গুম হয়ে ছিল, কারো আসার অপেক্ষায়। তারপর নিজে থেকেই হলুদ-সবুজ পাতা ঝরিয়ে একটা আচমকা অনুরণন জাগিয়ে দিল। এটা কি কান্না নাকি উদাসীনতা? বুঝতে সময় লাগবে আরও, আরও...

রুক্ষ জয়ন্তীর বুকে

এখান থেকে বেরিয়ে সূর্য যখন মধ্য গগনে, তখন নুড়ি পাথরে ঢেকে থাকা একটা শান্ত মেয়ের কাছে গেলাম, যার নাম জয়ন্তী। নাহ, চাঁদনী রাতের মোহমাখা রূপ দেখতে পাইনি বটে, তবে যা পেয়েছি সেই অনেক। যারা সারা শীতকাল জুড়ে নিজেদের উচ্ছাস গোপন করে রেখে দেয় বসন্তে আগল ভাঙবে বলে, তাদের এই সময়কার অচেনা রূপটা দেখতে আমার বড়ই ভাললাগে।

নুড়ি-পাথরে আগলে রাখা জলোচ্ছ্বাস

নুড়ি বালির ফাঁকে ফাঁকে খানিকটা জলখেলার পর, পেট চুঁই চুঁই করতে লাগল। তাই নদীতটের একদম সামনেই বেতের ছাউনি ঘেরা বনলতা রিসোর্টে বসে, খাওনদাওন সেরে নিলাম।

বনলতা রিসোর্ট
এরপরই শুরু হল বাঙালীর অতি পছন্দের দু’ ঘণ্টা ব্যাপী রহস্য রোমাঞ্চে ঘেরা, টানটান উত্তেজনার লাইভ থ্রিলার ফিল্ম, “জঙ্গল সাফারি”।

একটা হুড খোলা জিপ। সামনে ড্রাইভার ও আরও দুজন শাকরেদ আর পিছনে আমরা। পথ যত সরু হচ্ছে, জঙ্গল তত ঘন হচ্ছে। ডানদিক বা বাঁদিক থেকে আসা যেকোনো শব্দকেই তখন মনে হচ্ছে হাতির ডাক। ক্রমশ অরণ্য তার রুপ-রস-গন্ধকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কান ঘেঁসে ফিসফিস করে কীসব বলে গেল। তখনো কিছু পাখী আর একটা বাঁদর ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনি।

এটিই নাকি সেই নেকড়ের পায়ের ছাপ
একটু এগিয়ে যাবার পর দেখলাম, থাবা বসানো পায়ের ছাপ, লম্বা করে এগিয়ে গেছে বালিপথ ধরে। গাইড বলল, ওটা নাকি নেকড়ের, একটু আগে ওই রাস্তা দিয়ে গেছে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর…আমরা এগিয়ে গেলাম, আর সামনের আড়াল ভেদ করে ময়ূর দেখলাম। কি আনন্দ!

হতাশ করেনি যারা, রঙিন বড় তারা

গরীবের সবেতেই ফুর্তি। তারপর গাড়ি গিয়ে থামল ভিউ পয়েন্টে। একটা দোতলা কাঠের বাড়ি, নীচে ড্রাইভার ও তার শাকরেদরা মিলে তাস খেলছে। আমাদের বললেন, যান ওপরে গিয়ে বসুন, এখানে জলহস্থী জল খেতে আসে। সেই, ওদিকে শীত করছে, আলো ক্রমশ ফুরিয়ে আসবে আসবে করছে, আর আমরা চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করছি কখন বাবুমশাই তাঁর দুপুরের নিদ্রা সেরে জলপান করতে জলাশয়ে আসবেন। আমার ধৈর্য কম, ক্যমেরার লেন্সের শক্তিও কম তাই উঠে পড়লাম, ফেরার পথে যা পাব পাব এই ভাবনা নিয়ে।

অগত্যা, সময় কাটানো আর কী!
সূর্য ডোবার সাথে সাথে মনটাও হতাশায় ডুবে যাবে, এরকম একটা সময়ে সামনে তাকিয়ে দেখি এক শিংওলা পরিবার বাচ্চাকাচ্চা সমেত আমাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক!- তখন আর কিচ্ছু ভাবার টাইম নেই। ক্লিক শেষ, সিনেমাও শেষ। তারপর সব অন্ধকার।

শেষ পাতের ক্লাইমেক্স
জিপ থেকে নামার পরের অনুভূতি খুব শর্টে বলতে গেলে একদম সিনেমা হল থেকে বেরোনোর পরের অনুভূতির মতই। শীত কাকে বলে, এবার টের পাওয়া যাচ্ছে। তাই হালকা করে লাল চা খেয়ে আমাদের সান্ধ্যকালীন পাহাড় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

ইন্দ্রদা'র বাড়ি, রোভার্স ইন হোমস্টে, বক্সা
আমার গন্তব্য তখন বক্সা সদরবাজারের আছে ইন্দ্রদার বাড়ি। মোবাইল ফোন ততক্ষণে টাওয়ার শূন্য। সান্তালাবাড়িতে এসে আমাদের গাড়িটা আটকালো। রাস্তা খোঁড়া চলছে প্লাস এই সময়ে গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের ওপর ওঠা যাবেনা। হেঁটে গেলেও সঙ্গে গাইড নিতে হবে। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। ভেতরে যে উৎকণ্ঠাটা চলছিল, সেটা বাইরে বেরনোর পর একদম শান্ত হয়ে গেল। ছোট ছোট দুটো দোকানে ছিমছাম নেপালি গান বাজছে, আর মোমো তৈরি হচ্ছে। সেই নক্সাকাটা একটা ছবি, যেটা দেখবার জন্য মনটা আনচান করছিল অনেকক্ষণ।

দুপুরবেলার সান্তালাবাড়ি
অতঃপর খানিক বাক্যালাপের মাধ্যমে দুজন গাইডকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যেতে লাগলাম জিরো পয়েন্টের দিকে। পাহাড়ি অন্ধকার রাস্তায়, মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছনোর এ এক বিরল অভিজ্ঞতা, আমার মত এই নতুন অভিযাত্রীর কাছে- এর নামই অ্যাডভেঞ্চার।

এই সেই জিরো পয়েন্ট, যেখানে রাস্তা সারাইয়ের কাজ চলছিল
জিরো পয়েন্ট পেরিয়ে যাবার পর, তখন বেশ খানিকটা এনার্জি চলে এসেছে শরীরের মধ্যে। মনে হচ্ছে, চাইলে আরও কিছুক্ষণ হাঁটতে পারি। তাই আর দেরী না করে এগিয়ে গেলাম, আমাদের ঠাঁই নেবার ঘর, ইন্দ্রদার বাড়ির দিকে। পাহাড়ি রাস্তাটা যেখানে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে একটা নতুন বাঁক নিয়েছে, ঠিক সেখানেই লাল আলো জ্বলা কাঠের নীল বাড়িটাই আজ আমাদের রাত্রিনিবাস। চারপাশে ফুলের গন্ধ তখনও ম’ ম’ করছে। বাড়ি ঢুকতেই হৈ হৈ হৈ হৈ...একরাশ আনন্দ নিয়ে ইন্দ্রদা হাজির। এত দেরী কেন...এই, সেই...ঠিক নিকট আত্মীয়ের মতন। এই তো সবে আতিথেয়তার শুরু, তারপর বাকী সন্ধ্যেটা তো মায়ায় মায়ায় কেটে গেল।

আসর তখন জমজমাট
কোন ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে পারেন না ভদ্রলোক! বাঁশী, ঢোল, হারমোনিকা... এছাড়াও রয়েছে ওঁর নিজের তৈরি বাজনা “টুনা”। শুরু হল জীবনের গল্প, মাঝে মাঝে গান... “ওরে, নূতন যুগের ভরে” থেকে “পুরানো সেই দিনের কথা”...স্বরচিত কবিতা থেকে নেপালি গান...গাছের শিকড় কেটে-ছেঁটে বানানো নানান জিনিস যার প্রত্যেকটাই হাতের ম্যাজিকের মত, আর পাহাড়ি জীবনযাত্রার গল্পগুলো। এসব আবেশে জড়াতে জড়াতে কখন যে রাত ১১টা বেজে গেল টেরই পেলাম না। মনটা আরও কিছুক্ষণ এখানে পড়ে থাকতে চাইলেও শরীর চাইছিল না। তাই বাধ্য হয়ে খেতে নামলাম নীচের ঘরে। বাইরে তখন হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা। তাঁর মধ্যে, ইন্দ্রদার নিজের হাতে পরিবেশন করা গরম গরম ভাত, ডাল, তরকারি তখন অমৃতসমান। খাওয়াদাওয়া সেরে কাঁপতে কাঁপতে সটান বিছানায়। ঘুমে কাদা দুটো চোখ, মন তখনও গুনগুন করে চলেছে, “হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়...”

সকালের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘরময়

হোমস্টের বারান্দায়, সাবেক কালের ড্রেসিং টেবিল, জাঁদরেল আয়না আর ইন্দ্রদার প্রিয় ঢোল
সকাল হল মুরগীর ডাকে। বাথরুমে জল বরফ ঠাণ্ডা। তাও চটপট তৈরি হয়ে নিয়ে বাইরে যাবার জন্য মনটা ছটপট করতে লাগল। একটা সুন্দর সকাল বলতে ঠিক যা যা বোঝায়, তাঁর সবকটা উপাদানই ভরা ছিল সেদিন বাইরেটায়। পাখীর ডাক, ছিমছাম একটা নেপালি গান, কুয়াশা ঢাকা ছোট ছোট বাড়ি, বাগান জুড়ে লাল-নীল ফুল, রোদ মাখামাখি করে কুকুর ছানাদের খেলা আর দূর থেকে কালো হ্যাট, কালো বুট আর কালো সোয়েটার পরে হেঁটে আসা ৬২ বছরের একটা জোয়ান ছেলে- যাঁর ভালো নাম ইন্দ্র শঙ্কর থাপা।

রাতের সেই হাড়কাঁপানো নীচের ঘরটায় সকালের হিমেল আলো এসে পড়েছে তখন। ইন্দ্রদার ছোট্ট আদুরে মেয়েটা ওয়াই-ওয়াই বানিয়ে দিল আমাদের জন্য।

ইন্দ্রদার বানানো ভিউপয়েন্ট থেকে, যার নাম দিয়েছেন আদর করে টাইটানিক
খেয়েদেয়ে ব্যাগ পত্তর ইন্দ্রদা'র জিম্মায় রেখে বেরিয়ে পড়লাম লেপচাখার উদ্দেশে, হাতে রইল ইন্দ্রদা'র বানিয়ে দেওয়া রুটম্যাপ।

যাত্রাপথের নকশা কাটা চলছে তখন ইন্দ্রদা'র হাতে
সকাল ৯:৪০ এ শুরু হয়েছিল আমাদের যাত্রা। মাঝে কিছুক্ষণ বক্সা ফোর্টে ঘোরাঘুরি করেছিলাম।

বক্সা ফোর্টে সংগ্রামীদের স্মৃতির স্মারক

এই ফোর্টও ব্রিটিশ সরকার দখল করে নিয়েছিল কোচবিহারের রাজার থেকে এবং বাঁশের দুর্গ ক্রমে পাথরের দুর্গে রুপান্তরিত হয়েছিল। সেকালে দুর্গটিকে মূলত ভারত ও তিব্বতের মধ্যে রেশম বাণিজ্যের পথটিকে রক্ষা করার জন্য ভুটান রাজারা ব্যবহার করতেন।

বক্সা ফোর্ট
এখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে আমরা নদীর কলকল শব্দ পেয়ে উঁকি মেরে নীচে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতে করতে আর লোমশ পাহাড়ি কুকুরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে-পাতাতে, একটু-একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ওপরের দিকে।

লেপচাখার পথে

একটু একটু করে এগোচ্ছি, আর দেখছি খুদে-খুদে সরল চোখগুলো আমাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে, পিঠে বোঝা নিয়ে।

কখনো বা চ্যাপটা নাকের দস্যি ছেলেগুলো খিলখিলিয়ে হেসে উঠে, দৌড় দিচ্ছে উঁচুনিচু ওই সবুজ পথের বাঁকে বাঁকে।

হাঁটতে হাঁটতে দু' এক মিনিট জিরিয়ে নেওয়া পাহাড়ের কোলে

মাঝখানে একটা পয়েন্টে পৌঁছে, দিক নির্ধারণে খানিক কনফিউশান হলেও, স্থানীয় দু একজন লোকের দেখা মেলাতে বিশেষ অসুবিধেয় পড়তে হয়নি। ঘড়িতে যখন প্রায় ১১টা ছুঁই ছুঁই, তখন কানে এল গভীর নিষাদ ছোঁয়ানো প্রার্থনাসঙ্গীতের স্বর।

কৌতূহলবশত, ঝোপঝাড় পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম শব্দটার খুব কাছে। পৌঁছে দেখি স্থানীয় একজনের বাড়িতে, পূজাপার্বণ চলছে। অনুমতি নিয়ে পুজোর ঘরে প্রবেশ করলাম। বৌদ্ধিক বসনে আবৃত জনা দশেক পুরোহিত, নানান রকম সাঙ্গিতিক আকারইঙ্গিতের মাধ্যমে অদ্ভুত শান্তিময় পরিবেশ তৈরি করে চলেছেন। সামনে অধিষ্ঠিত স্বয়ং তথাগত, তাঁর সামনে রাখা আছে বিভিন্ন ফল, কেক, বিস্কুট, চকলেট ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী।

লেপচাখায় ওঠার আগে একটি বাড়ির ভিতরের উপাসনাগৃহ

ধীরে ধীরে মনের মধ্যে প্রশান্তি আসতে লাগল। বাইরে বেরিয়ে বাড়ির অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, এটি একটি বিশেষ পুজো, যা বছরে একবার আজকের দিনে তিথি মেনে হয়। তাই বাড়িতে আজ বিশেষ আয়োজন। এঁদের পুজোতে আমাদের পুজোর মত নিরামিষ ভোজ হয়না। রীতিমত, শুয়োর, মুরগী ইতাদি ঝলসিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়।

পুজোর ভোগের আয়োজন

একরাশ মুগ্ধতা সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে লেপচাখা ভিউ পয়েন্টের দিকে এগোতে লাগলাম।

ঝিলমিলিয়ে ওঠা রোদেলা বেলা, লেপচাখা ভিউ পয়েন্টে

একপাশে মনেস্ট্রি, আরেকপাশে ছোট ছোট দোকান, অন্যপাশটায় ২-৩টে হোমস্টে। আর যে দিকটা বাকী রইল সে দিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু মেঘে ঢাকা পাহাড় আর পাহাড়। লেপচাখার এই ছোট্ট গ্রামটা জুড়ে সারাটা দিন হিমেল রোদ মিশেমিলে এক অদ্ভুত লুকোচুরির খেলায় মত্ত হয়ে ছিল ওই ভুটিয়াদের বাচ্চাগুলোর সাথে।

ওরা তো ঠিক পাহাড়ের মতই স্নিগ্ধ!

লামাকে বলে কয়ে চাবি খুলিয়ে মনেস্ট্রির ভেতরে ঢুকলাম। নীরবতা যেন ইশারায় মাথা নত করে দিতে বলছে। মানুষগুলোর মধ্যে ছোট ছোট আশা আর প্রতিদিনের আনন্দে বেঁচে থাকা- এই নিয়েই প্রকৃতির গন্ধ মাখছে এরা রোজ...রোজ।

নৈশব্দ...!

লেপচাখা মনেস্ট্রির অভ্যন্তরে

ফিরে আসতে মন চাইছিল না, কিন্তু হাতে সময় কম, নেমে আসতে হবে অনেকটা, তাই বেরিয়ে পড়লাম। ফেরার পথেও সঙ্গী সেই পাহাড়ি লোমশ কুকুর, খানিকটা মহাভারতের স্বর্গ পর্বের মত।

মনটা খারাপ ওর, চলে যাচ্ছিলাম বলে

জংলা পাহাড়ি রাস্তা ধরে ফিরে চলা

ইনি তো থাকবেনই, আমার সব পথের সঙ্গী!
সান্তালাবাড়িতে নেমে সেই গতকালের পছন্দ করে যাওয়া ছোট্ট দোকানটায় লাঞ্চ সারলাম থুকপা আর মোমো দিয়ে।

স্বল্প আহারাদি
এটাই বক্সা সদরের মূল কেন্দ্র। এখানকার হাট থেকেই বাজারপত্র করে নিয়ে যেতে হয় সবাইকে। তাই বেশী করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বহন করতে হয়।

উফফফ!!!
কারণ, এতোটা পথ হেঁটে বারবার আসা সম্ভব না কারোর পক্ষেই, আর এলেও সবসময় জিনিস পাওয়াও যায়না। খাওয়াদাওয়া সেরে উঠে গাড়ি ধরে বেরিয়ে পড়লাম সেদিনের শেষ গন্তব্য রায়মাটাঙের দিকে।

রায়মাটাঙের পথে
রায়মাটাঙ হল ভুটান সীমান্তের কাছে বনদপ্তরের সংলগ্ন একটি বনভূমি অঞ্চল। এর এক ধারে রয়েছে, ছোট একটি নেপালি গ্রাম। আরেকদিকে গভীর অরণ্য।

যে নদীটা শুকিয়ে গেছে...
গোধূলির আলোয় অরণ্য আর আকাশের সবুজ-নীল রঙ, মিশেমিলে গেছে তখন পাখীর কলতানের সঙ্গে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে পাতার ওপর পা ফেলার খচমচ শব্দ...

রায়মাটাঙে গ্রামের ভেতর ছোট ছোট কাঠের বসতি

প্রকৃতির রঙ ক্রমশ ধূসর থেকে চাপা অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে, সমস্ত বনানী জুড়ে একটু একটু করে তৈরি হচ্ছে গহীন মায়াজাল...

ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
ঘড়ির কাঁটায় সময় এগিয়ে গেছে ৩০ মিনিট। ডাকছে ভুটান, সামনেই...

চলবে...
Comments