top of page

উত্তরের পথে পথে...৩

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Feb 17, 2021
  • 5 min read

Updated: Feb 19, 2021

শেষ পর্ব


গাড়ি ধরে সোজা হাসিমারা। স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় একটা হোটেল। ফোনে এসে গেছে টাওয়ার। আর ঘড়িতে যথারীতি ভুটানের সময় দেখাচ্ছে। সেদিনটা হালকা গল্পগুজব আর খাওয়াদাওয়া সেরে লোটাকম্বল গুছোতে লাগলাম। কারণ, পরের দিন রাতে ফেরার ট্রেন।


ভুটানের পথে


পরের দিনটা সকাল সকাল বেরিয়ে সিধে বাজারহাটের ভিড় টপকে পৌঁছে গেলাম ভুটানের প্রবেশদ্বার ফুন্টসলিং।



গরীবের বিদেশ দেখা, তাও আবার ভিসা, পাসপোর্ট ছাড়া। রাস্তাঘাট, মানুষজন, গাড়িঘোড়া নিয়মনিধি সবকিছু কী সুন্দর সুশৃঙ্খল! তাই দেখতেও ভালো লাগে।


ফুন্টসলিং ঢোকার পরেই চোখে পড়ে যে মনেস্ট্রির প্রবেশদ্বার


প্রথমে গেলাম রিচেন্ডিং গোম্পা মনেস্ট্রি। অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতার আবরণে ঘেরা গোটা মনেস্ট্রি জুড়ে।



এক আকাশ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রিচেন্ডিং গোম্পা মনেস্ট্রি


উপাসনা গৃহের প্রবেশদ্বার


রক্ষণাবেক্ষণের আদব-কায়দায় প্রাচীনত্বের ছাপ সেভাবে পড়েনি বললেই চলে।



এখান থেকে বেরিয়ে গেলাম সমতল থেকে ৪০০ মিটার ওপরে অবস্থিত, কারবান্ডি মনেস্ট্রিতে।


পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে কারবান্ডি মনেস্ট্রি

পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে প্রায় এখানে


একটা বিশাল এলাকা জুড়ে নির্মিত হয়েছে এই মনেস্ট্রি, যার একটা অংশ জুড়ে ছোট পাহাড়ি ঢিবি রয়েছে, আরেকটি দিক থেকে দেখা যায় গোটা ভুটান, ছোট ছোট দেশলাইয়ের বাক্সের মত।


এও আরেক তীর্থক্ষেত্র


এখানকার গাঢ় ঘন নীল আকাশ, মাটির ওপর ঢেউ খেলে যাওয়া জমি, আর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা মুখগুলোর নরম লালচে আভাটা দীর্ঘক্ষণ দেখতে দেখতে মায়া পড়ে গেল জায়গাটার ওপর।



ভুটান সাম্রাজ্য



ওদিকে বেলা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, আমরা মনেস্ট্রি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে থামলাম আবার সেই তাসী মার্কেট।


তাসী মার্কেট


প্রায় বিদেশে হাঁটাহাঁটি করছি এরকম একটা ভাব নিয়ে আমরা এদিক-ওদিক খানিক ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। গোটা অঞ্চলটা জুড়েই রয়েছে বেশ কিছু মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং, শপিং মল, রেস্তরাঁ এবং একটি পার্ক যার মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মনেস্ট্রি।


তাসী মার্কেট সংলগ্ন মনেস্ট্রি


অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করে প্রতিদিন এই রাস্তায়, তবে একেবারে ট্র্যাফিকের বিধিনিষেধ মেনে।


বৈচিত্রপূর্ণ স্থাপত্য


জিনিসপত্রের বেজায় দাম দেখে, আমরা অথেনটিক ভুটানিস থালির খোঁজে খাবারের দোকানগুলোর দিকে এগোতে লাগলাম। আমি সর্বভুক হওয়ায় চাউমিন, চিকেন রাইস, থুকপা সব একটু-একটু করে টেস্ট করতে বেশ ভালো লাগল। সবমিলিয়ে দেখলাম পেট বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে।


মুখে যেই হাসিগুলো দেখেছি

ভালোবাসা


হাতে সময় কম, তায় আবার ভুটান আধ ঘণ্টা এগিয়ে দেখাচ্ছে, এখনো আরেকটি প্রতীক্ষিত গন্তব্যে যাওয়া বাকী। তাই দেরী না করে গাড়িতে উঠে এগোতে লাগলাম, আমাদের শেষ গন্তব্য চিলাপাতা ফরেস্টের দিকে।



অরণ্যের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে একটু একটু করে বাড়ি ফেরার মজাই আলাদা। এ যেন পাহাড় থেকে সমতল আর সমতল থেকে কংক্রিটে ফেরবার বৃহত্তর সার্কেল। এটাকে দু-চার দিনের গণ্ডী বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে থেকে দেখে উপভোগ করা যায়না, উচিৎ নয়ও বোধহয়।


ছায়া ঘনাইছে বনে বনে


চিলাপাতার জঙ্গলের মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে নামবার পর টের পেলাম, এই কদিনে যে যে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করেছি, তার কাছে চিলাপাতার জঙ্গলের গভীরতা নস্যি। কান পাতলে এখানে শুধু নৈশব্দের চিৎকার শোনা যায়। সে চিৎকার হাওয়ায় হাওয়ায় পশ্চিমদিকে উড়ে গেলে, বনানী হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।



ঠিক এমনই একটা মুহূর্তে যেখানে যাওয়া আমাদের নিষেধ, সেখান থেকে, পাতার ওপর পায়ের খচমচ শব্দ আর মৃদু স্বরে গোঙানির আওয়াজ এল। ক্রমশ আওয়াজটা ঘনীভূত হল, তারপর আরো কাছে এলো, তারপর কিঞ্চিৎ ঝুঁকি নিয়ে উঁকি দিতেই তাকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। অতঃপর সে, রাজার মত ধীর পদক্ষেপে ফের ঝোপের আড়ালে লুক্কায়িত হল।



জঙ্গলটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই বাঁ হাতে বসেছে একটা ছোটখাটো হাট, নিত্যনৈমিত্তিক সামগ্রী নিয়ে।



সেদিক থেকে দেখতে গেলে আনন্দ পাবার কিছুই নেই, তবে এসব গ্রামীণ হাট দেখলে আমার কেমন আনন্দ হয়, ছোটবেলার কথা মনে পরে। তাই, বিকিকিনির নানান লোকের সাথে হুটহাট গল্প জুড়ে দিই যখন-তখন।

পাহাড়ি গঞ্জের হাট


কিন্তু ওদিকে ডাকাডাকি আরম্ভ হয়ে যাওয়ায়, গল্প বেশীদূর এগোতে না এগোতেই গাড়িতে উঠে পড়তে হল।

ঘরে ফেরার বেলা


দিন গড়ানোর সাথে সাথে গাড়ি ক্রমশ পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমে অরণ্য ভেদ করে, দু’পাশের চায়ের বাগানগুলো ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল আলিপুরদুয়ারের দিকে।



ভালোলাগছিলনা কিছু। প্রকৃতিকে বলতে না পারা বাকী কথাগুলো, কুঁকড়োতে, কুঁকড়োতে বিষন্নতার সর্পিল পথ তৈরি হচ্ছিল একটা মনে মনে। সবকিছু কি একবারে বলা যায়? এসব বলে, বুঝিয়ে তাকে খানিক সান্ত্বনা দিয়ে রাখছিলাম।



একেবারে ফেরার আগে মিনিট দশেকের জন্য নামা হল নিমতি ধাবায়। বেশ বড় একটা দোকান। এখানে গ্রসারীর সবরকম সামগ্রীর সাথে সাথে একধারে রয়েছে খাবার হোটেলও। টুকটাক জিনিস কিনে, আর চা খেয়ে এগিয়ে চললাম নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনের দিকে। হাতে সময় একদম কম।



স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন ট্রেন ছাড়তে মিনিট আটেক দেরী। একটু একটু করে লাল রঙের পদাতিকের কাছে যাচ্ছি, আর ভাবছি ফেলে আসা সময়গুলোর কথা।


ফেলে আসা মুখগুলো মনে পড়ে যায়


ফেরার ট্রেনটা যাবারটার তুলনায় খানিক বেটার ছিল সবদিক থেকেই। আশেপাশে কেউ খুব একটা কথাতথা বলছিল না বিশেষ। সবাই বোধহয় থমকে গেছিল। অরণ্য আর পাহাড়ের এ এক অদ্ভুত খেলা, শান্ত করে দিতে পারে হঠাৎ করে কিছুক্ষণের জন্য যে কাউকে।



রাতের ঘুমটা ক্লান্তির জেরে ভালোই হয়েছিল, তাই টেরই পাইনি কখন ট্রেন দমদম ঢুকে গেছে।



ফেরার সময়টা বড্ড তাড়াতাড়ি এসে যায়, যতটা না আসে যাবার সময়টা। ট্রেন থেকে নেমে, বাইরে এসে অনেকদিন পর দেখলাম, কুয়াশা ঘেরা সকালের শিয়ালদা ষ্টেশন। মনটা আবার ভালো হয়ে গেল। আচ্ছা, সময় ছাড়া আমরা আর কি কি ফেলে আসি বেড়াতে গিয়ে?



ভাবতে ভাবতে, কলকাতার রাজপথ আর সরণী বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বাড়ির পথে, নাকি উত্তরের পথে? কী জানি...!!



  • বিশেষ দ্রষ্টব্য-


১। ঠিক এই প্ল্যানটার মত করে বেড়াতে যেতে চাইলে টানা ৪ দিন লাগবে। আগের দিন রাতে ট্রেন ওঠা আর শেষ রাত কাটিয়ে সকালবেলা বাড়ি ফেরার সময়টা বাদ দিয়ে বললাম।


২। রাতের ট্রেনের ক্ষেত্রে হাওড়া থেকে কামরূপ এক্সপ্রেস আর শিয়ালদাহ থেকে উত্তর বঙ্গ ধরাই ভালো সময় বাঁচানোর জন্য আমার মতে। পদাতিক ভালো ট্রেন হলেও কোচবিহার পৌঁছতে বেলা হয়ে যায় যেহেতু, তাই সারাদিনে বেড়ানোর সময় কমে আসে। ফেরবার ক্ষেত্রে চাইলে ফুন্টসলিং ঘুরেটুরে হাসিমারা থেকে কাঞ্চনকন্যা ধরেও ফেরা যায়। যদি চিলাপাতা বা আলিপুরদুয়ার রুটের অন্য কোথাও যান, তাহলে নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে শিয়ালদাহের ক্ষেত্রে পদাতিক আর হাওড়ার ক্ষেত্রে সরাইঘাট এক্সপ্রেস বেশ ঠিকঠাক ট্রেন।


৩। থাকবার ক্ষেত্রে কোচবিহারে প্রচুর হোটেল রয়েছে, তাই বুক করে না গেলেও খুব একটা অসুবিধে নেই। তাছাড়া গুগুলে বেশীরভাগ হোটেলেরই যোগাযোগের নম্বর দেওয়া আছে। এবার বক্সার ক্ষেত্রে রোভারর্স ইন হোম স্টে (ইন্দ্রদার বাড়ি) সবসময় আমি রেকমেন্ড করব, কারণ এরকম আতিথেয়তা আর ব্যবহার আপনি আর কোথাও পাবেন না। এছাড়াও আরও দু-একটি হোম স্টে রয়েছে কাছাকাছি। আর যদি লেপচাখায় থাকতে চান, তাহলে বলব একদম লেপচাখা ভিউ পয়েন্টেই রয়েছে হেভেন অফ ডুয়ার্স, পামশা নামক হোমস্টেগুলি। আর যদি জয়ন্তীতে নদীর পাড়ে রাত কাটাতে চান, তাহলে তো রয়েছেই নদীতীরের একদম কাছে বনলতা রিসোর্ট এবং এর কাছাকাছি আরও কয়েকটা থাকার জায়গা। এরপর আমার মত হাসিমারায় থাকলে স্টেশনের কাছে কয়েকটা হোটেল পাবেন, তবে জাস্ট একটা রাত কাটানোর মত হলে ঠিক আছে। কারণ, হাসিমারা ষ্টেশন লাগোয়া অঞ্চল কিংবা হোটেল কোনটাই আমার সেরকম ঠিকঠাক লাগেনি। আর যদি আগে চিলাপাতা ফরেস্টে যান, তাহলে ওখানেই জঙ্গলের কাছকাছি কোন একটা হোমস্টে তে থাকতে পারেন। আমি বলব হাসিমারার থেকে সেটাই করা ভালো, তাহলে অন্তত প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ থাকবে।


৪। খাবারদাবারের ক্ষেত্রে কোচবিহার মূল শহরে বাঙালী খাবার দোকান পাবার ক্ষেত্রে সেরকম কোন অসুবিধা হবেনা। এছাড়া বক্সা বা অন্যান্য জায়গায় যেখানে হোমস্টে তে থাকবেন, খাবার তো সেখানেই বলা থাকে সাধারণত। বাইরে খাবার বলতে একদম দেশীয় মোমো, থুকপা জাতীয় খাবারই পাবেন। ফুন্টসলিং- এ তাসী মার্কেট খাওয়া-দাওয়া করবার জন্য সবথেকে ভালো জায়গা। এখানে বিভিন্ন ধরণের রেস্তরাঁ আর ছোট ছোট খাবারের দোকান রয়েছে। আপনার ইচ্ছে মত খাবার আর দাম দেখে রয়ে সয়ে ভিন্ন স্বাদের খাবার টেস্ট করতে পারবেন এখানে। তবে, চাইনিস বা ভুটানিস খাবারে অরুচি থাকলে চাপ আছে।


৫। গাড়ির ক্ষেত্রে ৩দিনের সম্পূর্ণ ঘোরাঘুরির জন্য কলকাতায় আপনার বাড়ি থেকে যদি গাড়ি বুক করে যান, তাহলে সমস্ত ডিটেলস এবং টাকাপয়সার হিসেবনিকেশ করে তারপরেই সবটা ফাইনালাইস করবেন। আর যদি না কথা বলা থাকে, তাহলে আলিপুরদুয়ার স্ট্যান্ডে বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের সাথে কথা বলেও ঘোরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমার ট্রেন, টোটো ও ৩ দিনের ওয়াগন সমেত সব মিলিয়ে ছুঁয়ে গেছিল ১০০০০ টাকা।


৬। যদি চার জনের গ্রুপে যান তাহলে কমপক্ষে এক একজনের পুরো ট্যুর মিলিয়ে খরচ হতে পারে ৬৫০০-৭০০০ টাকা। লোকসংখ্যা বাড়লে গ্যাঁটের খরচও কমবে খুব স্বাভাবিকভাবে। যাবার সময়- নভেম্বর থেকে মার্চ, আমরা জানিই সময়টা আইডিয়াল।


বাকীটা নিজের মত করে সাজিয়ে নেবেন। অতঃপর চরৈবেতি…।।



 
 
 

Comments


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page