জলপথে পাখীর অভিযান- পূর্বস্থলী
- Shrabanti Mitra
- Jan 5, 2021
- 5 min read
Updated: Jan 6, 2021

“তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গিয়েও আর পেলেম না/ দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা”... এমনটাই অবস্থা হয়েছিল আমার চুপির চরে পাখীর ছবি তুলতে গিয়ে। যার কপাল যেমন হয় আর কী! বন্দুকের তীক্ষ্ণ নলের মত জায়েন্ট জুম লেন্স না থাকা সত্যেও, পাখী দেখবার প্রবল ইচ্ছে ছিল ভেতরে কোথাও একটা। তার জেরেই রাত থাকতে ঘুম থেকে ওঠা, একটু জল আর কিছু শুকনো খাবার ব্যাগে ভরে বেরিয়ে পড়া। তারপর শিয়ালদাহ পৌঁছে সকাল ৫:৩৫ এর জঙ্গিপুর লোকাল ধরবার দুঃসাহসিক অভিযান(এই গল্পটা অন্য একদিন বলব)। ততক্ষণে পূব দিগন্তে সূর্যকিরণ ঝলক দিচ্ছে।

Small Pratincole
কাটোয়া লাইনটা একদম অন্যরকম। এখানে প্রতিটা স্টেশনেই গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কোন না কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এসব গল্পে গল্পে রোদটা যখন বেশ ঘন হয়ে উঠেছে, তখন দেখি পূর্বস্থলী এসে গেছি। নেমে একটা টোটো ধরে পৌঁছলাম পাখিরালয়ের ঘাটে। শ্যমলদা অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ঘাটে পৌঁছে দেখি নৌকোয় বসবার জন্য সব ব্যবস্থা পাকা। আর দেরী না করে শুরু করে দিলাম আমাদের জলপথের অভিযান।

গঙ্গাবক্ষে বিহঙ্গযান এমনি করেই
কোনোদিন ভাবিনি একসাথে একদিনে এত কাছ থেকে পাখী দেখা যেতে পারে। অশ্বক্ষুরের দেখতে একটা হৃদ। দুপাশটা সবুজ কচুরিপানায় থিকথিক করছে, তার মাঝে পানকৌড়ির খেলা...“নীল আকাশে কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা?” এসব লুকোচুরির খেলা। একটু করে নৌকা এগোচ্ছে, একটু করে করে প্রকৃতি আমাদের কাছে টেনে নিচ্ছে। শ্যাওলা ঘেরা জলাশয় থেকে মাঝেমধ্যেই ছোটোখাটো কয়েকটা মাছ নিজের মুখ দেখিয়েই ডুবে যাচ্ছে নিজের আস্তানায়।

অর্ধেক শরীর ডুবিয়ে জলপোহানো হাঁস

Pond heron/ কানি বক
হঠাৎ ডানদিকে চোখ যেতেই দেখি কয়েকটা গ্রে-হেডেড সোয়ামপেন আর কানিবক নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করছে, আর ভাবনাচিন্তা করে নিচ্ছে এই শহুরে দুই দর্শনার্থীকে ক’ সেকেন্ড পাত্তা দেবে, আর ক’সেকেন্ড পর পাখনা মেলে দেবে বিপরীত দিকে। যাইহোক, একটু আধটু ক্লিক টিক হলেই হবে আমার, এবারের মত। বেশী ডিম্যান্ড নেই এদের কাছে।

Grey headed swamphen/ কালেম

Grey headed swamphen/ কালেম
এবার কচুরিপানা সরিয়ে সরিয়ে শ্যামলদা বাঁ দিকটায় নিয়ে গেল আমাদের। “দেখতো, ওই লাল পোচার্ড জোড়াকে ধরতে পারো কিনা?”... আমি চেষ্টা করলাম। গরীবের ক্যামেরায় দু একখান ফ্রেম যা জুটল তাতেই আমি খুশী। কিন্তু শ্যামলদা খুশী নয়। কারণ, তার খিদেটা আমাদের থেকে বেশ খানিকটা বেশী। তাই সন্তর্পণে ধীরে ধীরে দাঁড় টেনে টেনে, সে আমাদের আরও খানিকটা কাছাকাছি নিয়ে গেল রাঙামুড়িগুলোর। এবার খুশীতে আমার ফ্রেমগুলো চকচক করে উঠল, আর সাথে সাথে শ্যামলদার মুখটাও।

Red-crested pochard/ রাঙামুড়ি
আগাছার বেড়া টপকে টপকে কয়েকটা ইগ্রেট সারস, কিছু মাছরাঙা আর পানকৌড়ি দেখার পর আমাদের জলপথের অভিযান যখন বেশ খানিকটা ঘন হয়েছে, তখন শ্যামলদা বলল, “তোমরা কি মায়াপুরের গঙ্গা অবধি যাবে?” মায়াপুরের গঙ্গা মানে তো...যার জন্য পাঁচ-ছ’ ঘন্টা কেউ কেউ ঠায় বসে থেকেছে নদীর পারে। আমি জানিনা ভাগ্যে কি আছে? তবুও বললাম, “যাব, চল।” শ্যামলদা বলল, “সঙ্গে শুকনো খাবার আছে তো?” এত খেয়াল সত্যিই মা ছাড়া আর কে রেখেছে আমি জানিনা।

Intermediate egret/ মাঝারি বক

Intermediate egret/মাঝারি বক

Black drongo/ ফিঙে

Intermediate egret/মাঝারি বক
টুকটাক মুখ চলছে, দু পাশারি গাছগাছালি আমাদের মুখ-নাক স্পর্শ করছে প্রায়। চোখ বন্ধ করলে জলের ছলাৎছলাৎ শব্দ, গাছগাছালির ধার ঘেঁষে যাওয়া খসখস শব্দ, আর পাখী, কীটপতঙ্গ মেশা জলের তরঙ্গের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে সৃষ্টি হওয়া একটা নতুন রাগের মালা। যার সুদীর্ঘ বিস্তার কানে আরাম দিতে দিতে এগিয়ে নিয়ে চলে আমাদের মাঝগঙ্গার দিকে।

Little cormorant/ ছোট পানকৌড়ি

Little cormorant/ ছোট পানকৌড়ি

Little cormorant/ ছোট পানকৌড়ি
গঙ্গা অবধি পৌঁছে শ্যামলদা যখন নৌকাটা থামাল, তখন একটু দূরে তাকিয়ে দেখলাম বাঁশের ওপর একটা অদ্ভুত জীব বসে আছে, কতকটা ঠিক এরকম, যেন তাকে কেউ বিরক্ত না করে। শ্যামলদা ইশারা করতেই বুঝলাম, এই সেই আমাদের সেইদিনের স্বপ্নের নায়িকা অসপ্রে বা মাছমোরাল। তবে, তার এখন স্নানখাওয়া সেরে এলো চুলে জিরোবার পালা।

Osprey/ মাছমোরাল
দীর্ঘক্ষণ পাণিপ্রার্থী হয়ে অপেক্ষা করবার পরও, তার ডানা মেলা উড়াল দেবার মুহূর্তটা ক্যামেরা বন্দী করা গেল না। সে অবশ্য মনে মনে ভাবছিল তখন, “হু হু বাওয়া, এসব অনেকদিনের সাধনার ফসল। আমার পেছনে কত ছোকরার লাইন, আর তুমি একদিন এসে সবকিছু দেখে নেবে, তা কি করে হয়?” হয়না তো। তাই ফিরে আসতে হয় বারবার প্রকৃতি, আর তার চারধারে ঘিরে থাকা, সুন্দরীদের কাছে।

Little ringed plover/ ছোট নথজিরিয়া

Bronze winged jacana/জলপিপি
নদীর চরে তখন মাছ ধরার বিশাল আয়োজন। ঠিক মত টোপ ফেললে নাকি ইলিশ পর্যন্ত ওঠে! শ্যমলদা বলল, “এই শীতকালের দিকটা এত লোকে, পিকনিক করে, প্ল্যাস্টিক ফেলে যে আগের মতন তেমন মাছও ওঠেনা, আর পাখীরাও ভয় পেয়ে যায়।” এদিক-ওদিক বেশ খানিকটা ঘুরে আমরা আবার নৌকোয় উঠে পড়লাম। উল্টোদিকে মায়াপুরের মন্দির। জলপথে তীর্থস্থান ভ্রমণের ব্যাপারই আলাদা। খানিকটা রথ দেখা, কলা বেচা গোছের পুলক মনের মধ্যে অনুভব করে, ফিরে চললাম আবার গাছগাছালি ভেদ করে।

Common Kingfisher/ ছোট মাছরাঙা

Red-crested pochard/রাঙামুড়ি
সূর্যের আলো তখন পশ্চিম প্রান্তে। আমাদের সঙ্গে যা খাবার ছিল, শ্যামলদাকে বললাম, “খেয়ে নাও”। শ্যামলদাকে বলে, “দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে তোমাদের রেড পোচার্ডের কাছে নিয়ে যাই। এই সময়টায় ওরা বেরোয় আবার। অসপ্রে তো ভালো করে তোলা হল না। এটা দেখ, কেমন হয়।” আমি যত জায়গায় গেছি, আর যতরকম সারথিদের সঙ্গ পেয়েছি, তাদের মধ্যে এখনো অবধি সবার সেরা শ্যামলদা।

আমাদের শ্যামলদা
“আচ্ছা, তুমি এত পাখীর নাম মনে রাখো কিকরে? আমার কিন্তু নামগুলো খুব গুলিয়ে যায়।”
শ্যামলদা বলল, “যখন যা বই পাই পড়ি, পাখিই তো আমার সব গো”।
“আচ্ছা, তুমি বছরের অন্য সময়টা কি কর? যখন লোকজন বিশেষ আসেনা।”
শ্যামলদা বলে, “কি করব! মাছ ধরি, নৌকা চালিয়ে এদিক সেইদিক ঘুরে বেড়াই, এসব ছাড়া আর কিছু ভাললাগেনা।”
“আচ্ছা, তোমার ছেলের সখ আছে পাখীর তোমার মত?”
শ্যামলদা বলে, “না ও একটু পড়াশুনা নিয়ে থাকতেই ভালোবাসে। তবে, আমি ওকে জোর করবনা। ওর যেটা ইচ্ছে করবে করতে সেটাই করুক।”

ছলকে ওঠে নদীর জল/ বিহঙ্গ তুই গল্প বল
প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানুষ গুলো কত সহজ ভাবে সত্যিটা বলে দিতে পারে, তাইনা? কথাগুলোর মধ্যে কোন খাদ ছিল না। এসব গল্প করতে করতে আমরা তখন রাঙামুড়িগুলোর কাছে পৌঁছে গেছি। বিকেলের হলুদ আলোয়, সারিসারি রাঙামুড়িদের গলাটা তখন জ্বলজ্বল করছিল।

দুপুরের পাখপাখালি

রাঙামুড়ির জলকেলি
সাধ মেটালাম যতটা পারা যায়। তবে, মানুষের গন্ধ আর শাটারের শব্দ পেলে কয়েক সেকেন্ডে অদৃশ্য হয়ে যায় এরা। বাঁ দিকে চোখ রাখতেই হঠাৎ দেখি সাইবেরিয়ার পরিযায়ী ওপেন বিল্ল্ড স্টর্ক...

Open billed stork/শামুকখোল
দু একটা ক্লিক করবার আমার চোখ চলে গেল বাঁশের ওপর বসে থাকা লাল-হলুদ মাছরাঙাটার ওপর। কত রঙ ওর শরীরে!

Stork billed kingfisher/মেঘহও মাছরাঙা

Common Kingfisher/ছোট মাছরাঙা
আমার শিশুমন তাই দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল। শ্যামলদা বলল, “ধুর, ওদিকে না, ডানদিকটা দেখ, জলপিপিটা...ওসব যখন আসবে তখনই দেখতে পাবে, এগুলো রেয়ার জিনিস।” শিশুমন রেয়ার জিনিসের আর কি বোঝে! সে যাই দেখে, তাতেই তার বালখিল্যতা প্রকাশ পায়। এরকম আরও কিছু টুকিটাকি রসদ সংগ্রহ করতে করতে আমরা পাড়ের দিকে এগোতে লাগলাম।

Bronze winged jacana/জলপিপি

Little cormorant/ছোট পানকৌড়ি
সূর্যরশ্মি তখন তার চিরাচরিত আগুণরঙা ছটায় রাঙিয়ে তুলেছে পূর্বস্থলীর গোটা আকাশটা। কিচিমিচি কলতানে পাখীগুলো সব আগুণরঙা গোল থালাটার চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে। শ্যামলদা বলছে, তোমাদের তো ট্রেনের টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি আমার ছোটোখাটো লেন্সটাকে তাক করে শেষবারের মত মুহূর্তবন্দী করে নিচ্ছি পাখীদের চলাচলটাকে।

Red-crested pochard/ রাঙামুড়ি

Little cormorant/ছোট পানকৌড়ি

Stork billed kingfisher/মেঘহও মাছরাঙা, ওদিকে ফিঙে
বাঁধাছাঁদা করে নিয়ে ঘাটে ওঠার পর দেখি নদীর চরাচরটা শান্ত হয়ে গেছে গোধূলির নীল আলোয়। পাখীরাও সব ফিরে গেছে একে একে নিজের নিজের বাসায়। এবার আমাদের বাসায় ফেরার পালা।

"যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে, সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া, যদিও সঙ্গী নহি অনন্ত অম্বরে/
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া, মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে, দিক্-দিগন্ত অবগুন্ঠনে ঢাকা/
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর/ এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা..."- দুঃসময়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু ক্যামেরাবন্দী করতে নয়, খোলা আকাশের নীচে একরাশ অনাবিল আনন্দের ঘ্রাণ নিতে যদি ইচ্ছে করে, তাহলে পূর্বস্থলী একবার নয় বারবার আসতে হবে আপনাকে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
*জলে আবর্জনা আর প্ল্যাস্টিক ফেলবেন না।
*মাইক বাজাবেন না বা জোরে চিৎকার করবেন না।
*নৌকায় থাকাকালীন জোরে কথা বলবেন না বা শব্দ করবেন না।
*উজ্জল রঙের পোশাক পরবেন না।
*পাখীরালয়ে রবিবার আর ছুটির দিন ছাড়া যান।
*নৌকায় থাকাকালীন ধূমপান বা মদ্যপান করবেন না। মাঝিভাইয়ের পরামর্শ মেনে চলুন যথাসম্ভব।
*পাখীরালয়ে পাখী দেখবার আদর্শ সময় নভেম্বর মাসের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারীর শুরু অবধি। বাকিটা আবহাওয়া দপ্তরের হাতে।
*ছবি তোলার ক্ষেত্রে ধৈর্য আর ভালো জুম লেন্স ম্যান্ডেটারি।
**অনেকেই চাইলে দুদিন থেকেও আসতে পারেন। তার জন্য পাখীরালয়ের ঘাটের সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে “কাষ্ঠশালী পরিযায়ী আবাস”। এছাড়াও এর আশেপাশে এখন আরও কিছু গেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে। একটু গুগুল করলেই বুকিং-এর জন্য যোগাযোগ করা যাবে।
**গেস্ট হাউসে থাকলে সেখান থেকেই খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর না থাকলে সঙ্গে শুকনো খাবার রাখবেন নৌকায় সারাদিনের জন্য। এছাড়া অনেকসময় মাঝিভাইদের আগে থেকে বলে রাখলে ওনারাও ব্যবস্থা করে দেন দুপুরের খাবারের।
**মাঝিভাইয়ের জন্য যোগাযোগঃ শ্যামল রাজবংশীঃ- ৯৬৪৭২৮৫৫৬৮।
*নৌকার ভাড়া- ১৫০ টাকা/ঘণ্টা।

Comments