top of page

ডাচ নগরীর গাজন উৎসব

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Apr 14, 2022
  • 6 min read

ree

"ক্রমে দিন ঘুনিয়ে এল, আজ বৈকালে কাঁটাঝাঁপ! আমাদের বাবুর চার পুরুষের মূল সন্ন্যাসী কানে বিল্বপত্র গুঁজে, হাতে এক মুটো বিল্বপত্র নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বৈঠকখানায় উপস্থিত হল ; সে নিজে কাওরা হলেও আজ শিবত্ব পেয়েচে, সুতরাং বাবু তারে নমস্কার কল্লেন ; মূল সন্ন্যাসী এক পা কাদা সুদ্ধ ধোব ফরাশের উপর দিয়ে বাবুর মাতায় আশীর্বাদী ফুল ছোঁয়ালেন,-বাবু তটস্থ!"

- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্রথম ভাগ।


ree

বঙ্গজীবনে বারোমাসে তেরোপার্বণের এমন কোন পার্বণ নেই, যা নিয়ে হুতোম লিখে যাননি। আজ চড়ক। বাঙালীর তেরো নম্বর পার্বণের চরম মূহূর্ত আজ। চৈত্রের সোনার আভায় মোড়া সূর্যাস্তের অন্তিম ক্ষণকাল। আজকের এই উৎসব যে প্রকৃত অর্থে বাংলার লোকউৎসবের জ্বলন্ত একটি উদাহরণ, তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না।


ree

শিব, মনসা, নীল ও ধর্ম ঠাকুর মূলত এই চারজন দেবদেবীকে স্মরণ করেই শুরু হয় চৈত্রমাসের শেষ সপ্তাহে গাজনের পালা। 'গাজন' অর্থাৎ 'গর্জন'। এই উৎসবে ব্রত পালনকারী যে সমস্ত সন্ন্যাসী উপবাসে থাকেন এবং ইষ্টদেবতার কৃচ্ছসাধনের উদ্দেশ্যে নানান শারীরিক ক্রিয়াকলাপ চালান, সেই সব ক্রিয়াকলাপের বিশেষ মুহূর্তে অত্যন্ত গর্জন সহকারে তাঁরা ঈশ্বরকে ডাকতে থাকেন শারীরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে; সেখান থেকে লোকমুখে এই উৎসবের নাম হয়ে ওঠে 'গাজন'।


ree

আবার অন্যমতে, গ্রামে-গঞ্জে যেহেতু এই উৎসব বেশী লক্ষ্য করা যায় স্থানীয় সকল বাসিন্দাদের একত্র করে গ্রামীণ শিবমন্দিরের আনাচে-কানাচে, তাই একে ('গাঁ' অর্থাৎ গ্রাম 'জন' অর্থাৎ জনগণ) "গাজন" বলা হয়। তবে গাজনই সেই উৎসব, যেখানে সেকাল থেকে একাল ভেদাভেদ ভুলে সমস্ত শ্রেনীর মানুষ শিবশক্তির উপাসনা করতে পারেন। সারাবছর যেখানে শিবঠাকুর একসময় ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যে সেবা পেতেন, সেখানে গাজন ছিল ঈশ্বরকে স্পর্শ করার এক পরম শুভক্ষণ। তাই এ সময় দেবাদিদেব জনসমাজে হয়ে ওঠেন গণদেবতা।


ree

বলা হয় বলা হয় সূর্য ও পৃথিবীর বন্ধনই হল এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। তাই বৃষ্টিলাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজে এই উৎসবের উদ্ভাবন ঘটেছিল বলা হয়। এই সমগ্র উৎসবকে কেন্দ্র করে সন্ন্যাসীরা ঠাকুরের কাছে মানত করেন, হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন এবং উত্তরীয় ও একখন্ড বেত্র ধারণ করেন। এঁদের কৃচ্ছসাধন অর্থাৎ নানান শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে রয়েছে তারকাঁটায় জিহ্বা ফোঁড়া, কাঁটাঝাঁপ, বঁটিঝাঁপ, আগুনঝাঁপ, ঝুলঝাঁপ, বান ফোঁড়া, কপাল ফোঁড়া ইত্যাদি।


ree

এই সমস্ত কৃচ্ছসাধনের পাশাপাশিও গাজনের আরেকটি মূল আকর্ষণ হলো 'সং'। হরগৌরী, কালী, কৃষ্ণ, শিব থেকে শুরু করে একশো তেত্রিশ কোটি দেবতার হরেক রূপের সাজে গ্রাম থেকে শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ান যে বহুরূপীরা, তাদেরকেই আমরা 'সং' বলে চিনি। তবে শুধু সাজ নয়, এর সঙ্গে বেশ কিছু অঞ্চলে গাজনের দিনগুলোয় দেখা যায় 'কালীনাচ'। পাশাপাশি, এখনো কিছু গ্রামে নরমুণ্ড অথবা গলিত শব নিয়ে নৃত্যের তালে তালে জমজমাট মোচ্ছব পালন করা হয়।


ree

'বাবা তারকনাথের চরণের সেবা' হয়না এমন কোন স্থান নেই বঙ্গভূমিতে। তাই গাজন আর চড়কের সপ্তাহব্যাপী পাব্বনও সব স্থানেই হয়। তবে জেলার মধ্যে বিশেষভাবে হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বীরভূমের উৎসব বিখ্যাত।


আজ বলব চুঁচুড়ার ষন্ডেশ্বরতলার গাজন উৎসবের কথা। সে প্রায় পাঁচশ বছর আগেকার কথা। চিনসুরা তখনও ওলন্দাজ নগরী হয়ে ওঠেনি, চুঁচুড়া তখনও বাংলার বাকি সব জেলার মতোই জলা-জঙ্গলে ঘেরা সাদামাটা গাঁ। এমন সময় একদিন শিবভক্ত ব্রাহ্মণ দিগম্বর হালদার স্বপ্নাদেশ পেলেন ষন্ডেশ্বরের।ষন্ডেশ্বর অর্থাৎ ষন্ডরূঢ়া ঈশ্বর মানে স্বয়ং মহাদেব। দিগম্বরবাবুকে তিনি নির্দেশ দিলেন, “আমি শ্মশান সংলগ্ন ভাগীরথীর জলে নিমজ্জিত আছি। আগামী রথযাত্রার পরদিবস শুভ তৃতীয়া তিথিতে তেওর (জেলে) সম্প্রদায়ভুক্ত নীলমণি জেলের দ্বারা ভাগীরথীতে জাল ফেলিয়া আমার মূর্তি উদ্ধার কর এবং আমার যথারীতি নিত্য পূজার্চ্চনার ব্যবস্থা কর”। ভক্ত দিগম্বর এমন স্বপ্নাদেশ পেয়ে যথারীতি আদেশ রক্ষার কাজে সমর্পণ করলেন নিজেকে। তিনি ষন্ডেশ্বর শিবলিঙ্গ উদ্ধার করে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করলেন ভাগীরথীর তীরে শ্মশানের মাঝখানে। এরপর থেকে সেখানে দিগম্বর হালদার সহ নীলমণি তেওর নামের এক জেলে, এক কামার ও এক রুইদাস মিলে শুরু করলেন ষন্ডেশ্বরের নিত্যপূজা। ষন্ডেশ্বর জীউ ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন চুঁচুড়ার গ্রাম্যদেবতা।


ree

ষন্ডেশ্বর জীউ মন্দিরের শিবলিঙ্গ


কিন্তু দেবতার মন্দিরটি কালের নিয়মে সেই জরাজীর্ণ হয়েই পড়ে রইল বাকি আর পাঁচটা জায়গার মতো। তারপর বহু দিন পর প্রায় বিংশ শতকের শেষার্ধে এসে টনক নড়ল স্থানীয় লোকজনের। সবাই মিলে উদ্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ষন্ডেশ্বর জীউ মন্দির সংস্কার সমিতি। চুঁচুড়ার তৎকালীন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ মুরারিমোহন মুখোপাধ্যায় হলেন সেই সমিতির সভাপতি। মূলত তাঁর বদান্যতাতেই স্থপতি উপেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদারের পরামর্শমত ১৯৭৪ সালের, ৪ঠা মে ৮৭ ফুট উঁচু ৬টি তলবিশিষ্ট শ্বেতপাথরের মন্দিরটি গড়ে উঠল ষন্ডেশ্বরতলায়।



ree

বিগত ৩০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে প্রতি বছর ষন্ডেশ্বর জীউর গাজন উৎসব ধুমধাম করে পালন করা হচ্ছে। এই গাজন পর্ব চলে চৈত্র মাসের ২১ অথবা ২২ তারিখ থেকে শুরু করে ১লা বৈশাখ অবধি। মজার ব্যাপার এই যে, ১১ দিন ব্যাপী এই গাজন উৎসবে জাতিভেদে যে কোন হিন্দু পুরুষ সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করতে পারেন। নিয়ম অনুযায়ী, একজন মূল সন্ন্যাসী বাকি সন্ন্যাসীদের পরিচালনা করেন। যারা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন, তারা নতুন গেরুয়া বস্ত্র ও উপবীত ধারণ করেন, সাথে চলে সাত্ত্বিক জীবনযাপন সহ গাজনের শেষ দিন পর্যন্ত একবেলা হবিষ্যান্ন আহার। গাজন উপলক্ষে সন্ন্যাসীরা ষন্ডেশ্বরতলায় বিশেষ অঙ্গভঙ্গি করে ঢাকের তালে নাচগানের মাধ্যমে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন, যাঁকে এঁরা বলেন, ‘খাটাখাটুনি’।


ree

প্রসঙ্গত, দিগম্বর হালদারের উদ্ধার করা তামার ফলকটি থেকে জানা যায়, আগে ষন্ডেশ্বর জীউ ছিলেন উড়িষ্যার, মতান্তরে মগধের পিপ্পিলী নগরের রাজবংশের গৃহদেবতা। তামার ফলকে বর্ণিত পূজাপদ্ধতি অনুযায়ী, পিপ্পিলীর রাজবংশের রাজা মূলী এবং দ্বারপালক, হনুমন্ত, ভাণ্ডারী, নীলপাত্র, মদন ও ভবতী নামের আরও ছয়জন পরম শিবাসক্ত প্রতিরূপী ৭জন সন্ন্যাসী আজও এই ষন্ডেশ্বরের গাজনের যাবতীয় কার্যকলাপের মূলে। এঁরা ছাড়া এই উৎসবে যোগদান করেন পুরোহিত, ভোগরন্ধনকারী, ভোগাধিকারী, সেবায়েতের পক্ষে একজন, দুজন ঢাকি এবং সাধুনী ও দেউলী কোটাল। এখনো এখানে দিগম্বর হালদারের উদ্ধার করা তামার পাতে লেখা নিয়ম অনুসারেই, পূর্বপুরুষের ধারা বজায় রেখে বংশানুক্রমে উদ্ধৃত গোপন মন্ত্র উচ্চারণ করে গাজনের পুজো সম্পন্ন করেন সন্ন্যাসীরা।


ree

গঙ্গাস্নান সেরে সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে বিশেষ পুজার্চ্চনা সন্ন্যাসীদের ঝাঁপ শুরুর আগে


এই উৎসবের লৌকিক রীতিনীতির তাণ্ডব দেখে ১৮০৩ সালে চুঁচুড়ার তৎকালীন ওলন্দাজ গভর্ণর জে.এন. বার্চ সন্ন্যাসীদের ঝাঁপের ওপর প্রবল নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তবে স্থানীয়দের প্রতিবাদের পর, সন্ন্যাসীরা উঁচু মঞ্চের ওপর থেকে ধারালো বাণের উপর ঝাঁপ দেন। তাতে সন্ন্যাসীরা আহত হবার বদলে বাণ ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যায়। এই ঘটনার পর বার্চ সাহেব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং ষন্ডেশ্বর জীউকে একটি অষ্টধাতুর পঞ্চমুখ ও একটি পিতলের ঢাক অনুদান করেন। এর পরবর্তীকালে স্থানীয় লাহা পরিবারের সদস্যরা আরেকটি পিতলের ঢাক এবং একটি অষ্টধাতুর ষন্ডেশ্বর মূর্তি দান করেন। এই ঢাকদুটিই আজও গাজনের সময় প্রতিবছর বাজানো হয়। এছাড়া ওলন্দাজদের দেওয়া অষ্টধাতুর পঞ্চমুখ এবং লাহাদের দেওয়া অষ্টধাতুর ষন্ডেশ্বরের মূর্তিটিও শিবলিঙ্গের ওপর বসানো হয়।


ree

সংক্রান্তির দিন ঝাঁপ শুরুর আগে মন্দিরের শিবলিঙ্গের স্নানপর্ব


  • এবার আসি অনুষ্ঠানসূচীর কথায়...


ree

গাজনের প্রথম দিন অর্থাৎ ২১শে চৈত্র সকালে ষন্ডেশ্বর জীউর অভিষেক ও মন্দিরের ভিতরে শিবলিঙ্গের পিছনে পোঁতা ত্রিশূলের কাছে কামাখ্যাদেবীর ঘট প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করা হয় এখানে। এরপর থেকে নবম দিন অর্থাৎ ২৩শে চৈত্র থেকে ২৯শে চৈত্র পর্যন্ত প্রতিদিন সারারাত ধরে চলে ঢাকের বাজনার সাথে সন্ন্যাসীদের ‘খাটাখাটুনি'। অষ্টম দিন, ২৮শে চৈত্র সকালে মূল সন্ন্যাসী ঢাক-ঢোলের বাজনা বাজাতে বাজাতে গৃহস্থদের মঙ্গল কামনা করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান এবং গৃহস্থরা সন্ন্যাসীর পা ধুয়ে দিয়ে তাঁকে নানাপ্রকার খাদ্যসামগ্রী এবং অর্থ উপহার দেন। দুপুরবেলা পুজো ও ভোগ নিবেদনের পর ভোগের হাঁড়িটিকে সুসজ্জিত করে সেটিকে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। এইদিন সন্ন্যাসীরা হবিষ্য করেন না, কেবল ফলাহারেই কাটিয়ে দিতে হয় তাঁদের সমস্ত দিন।


ree

এরপর নীলষষ্ঠীর দিন মূল সন্ন্যাসী ষন্ডেশ্বরতলায় ‘খাটাখাটুনি’ প্রদর্শন করলে, তাঁর কপালে মন্ত্রপূত লীলাবতী ডাব ছোঁয়ানো হয় এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি সেই মুহূর্তে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়েন জনসমক্ষে। এমতাবস্থায় তাঁকে বাকি সন্ন্যাসীরা কোনরকমে নিয়ে আসেন গঙ্গার ঘাটে এবং গঙ্গার জলে তাঁর সারা শরীর দিয়ে ধুয়ে দিয়ে, তাঁর কানে শিবমন্ত্র জপ করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সন্ন্যাসীর মূর্চ্ছাভঙ্গ হলে আমশাখাওয়ালা লীলাবতী ঘট এনে ষন্ডেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গণে একটি মেহগনি গাছের নীচে স্থাপন করা হয় এবং ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শাস্ত্রমতে হর-পার্বতীর বিবাহ পর্ব সারা হয় সমস্ত সন্ধ্যে জুড়ে।


ree

এই গাছের নীচেই যাবতীয় রীতিনীতি পালন করা হয়


এরপর আসে সংক্রান্তির দিন, যেদিনকে কেন্দ্র করে যাবতীয় উত্তেজনা এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে গোটা চুঁচুড়া শহর জুড়ে। সকাল থেকে হৈ হৈ পড়ে যায় প্রায় ষন্ডেশ্বরতলায়। অগণিত ভক্তগণ শিবের মাথায় গঙ্গাজল ঢালার জন্য মন্দিরে আসেন ক্রমাগত।


ree

মাথার ওপর চড়কের পাটা নিয়ে ঘাটের দিকে এগোচ্ছেন সন্ন্যাসীগণ

ree

দুপুরে মন্দির থেকে বাণেশ্বরকে বের করা হয় এবং সন্ন্যাসীরা চড়কের পাটাগুলিকে মাথায় নিয়ে শোভাযাত্রা করে গঙ্গায় গিয়ে স্নান করেন এবং ধর্মাধিকারীর নেতৃত্বে বাণেশ্বর ও সূর্যদেবের বিশেষ অর্চ্চনা করেন।


ree

গঙ্গাস্নান, পুজার্চ্চনা

ree

পুজো শেষে চড়কের পাটাগুলি গঙ্গাজলে শুদ্ধ করে নেবার পালা


এরপর চড়কের পাটাগুলিকে মাথায় নিয়ে হালদার পরিবারের প্রধান পুরুষের নেতৃত্বে সন্ন্যাসীরা সমগ্র ষন্ডেশ্বর মন্দির চত্বরটি প্রদক্ষিণ করেন পরপর সাতবার।


ree

এরপর বিকেলে শুরু হয় সেদিনের মূল আকর্ষণ চড়কের ঝাঁপ। সেইহেতু, মন্দির প্রাঙ্গণে এক তলার সমান উঁচু একটি বাঁশের মঞ্চ তৈরি করা হয় প্রথমে, যার নীচে অনেকে মিলে মোটা দড়ির জ্বাল মেলে ধরে।


ree

সেই দড়ির ওপরে পাতা হয় বঁটিযুক্ত চড়কের পাটা। সন্ন্যাসীদের কাঁধে করে নিয়ে এসে তুলে দেওয়া হয় ওই মঞ্চের ওপরে।

ree

তারপর তাঁরা এক এক করে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে থাকেন মঞ্চ থেকে নীচে সাজানো পাটার ওপরে। প্রত্যেকবার একজন করে নীচে পড়া মাত্রই দর্শকদের মধ্যে থেকে প্রবল উত্তেজনা আর উৎসাহ ‘ভোলে ভোলে’ রব তোলে চতুর্দিকে। এইভাবে এক এক করে সাতজন সন্ন্যাসীর ঝাঁপের পর সেদিনের মতো যাবতীয় রীতিনীতি শেষ হয়।


ree

মূল সন্ন্যাসীকে উৎসাহ যোগাতে বাকি সন্ন্যাসীদের হর্ষধ্বনি আর কলরোল


ree

স্বস্নেহে ধরে ফেলা ঝাঁপ শেষে


গাজনের শেষ দিন, ১লা বৈশাখ। সেদিন সকালবেলা সন্ন্যাসীরা ক্ষৌরকর্ম সেরে গেরুয়া কাপড় ছেড়ে পরিবৃত হন সাদা পোশাকে, তারপর ফিরে যান গৃহস্থাশ্রমে। এদিন পুজো ও প্রসাদ বিতরণের পর মাঝরাতে চলে ভৈরবনাথের বিশেষ পুজোপর্ব। এই পুজোর রীতি অনুযায়ী, দু'টি ছাগবলির রক্ত দিয়ে ভৈরবনাথকে স্নান করানো হয় প্রথমে, পরে সাত হাঁড়ি ভাত, সাত মালসা মুসুর ডাল সহ বলি দেওয়া দু'টি ছাগলের সাতটি পা ও সাতটি শোল মাছ পুড়িয়ে ভোগ প্রদান করা হয় ভৈরবদের। অদ্ভুতভাবে এই সময় গোটা চত্বরের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় এবং অধিকারী ছাড়া প্রত্যেকের প্রবেশ নিষেধ থাকে। একদম শেষে কামাখ্যাদেবীর ঘট বিসর্জন এবং ভক্তদের মধ্যে শান্তিজল দিয়ে সমাপন হয় গাজন উৎসবের।


ree

প্রসাদ বিতরণ পর্ব ভক্তগণের মধ্যে


এই গাজন উৎসব উপলক্ষে প্রত্যেক বছর পয়লা বৈশাখে ষন্ডেশ্বরতলায় হরেক কিসিমের পসরা নিয়ে বসে 'বৈশাখী মেলা'। এককালে ষন্ডেশ্বরের গাজন উপলক্ষে চুঁচুড়ায় বিরাট সঙ বেরোতো। সেই সঙের যাত্রা নিয়েই সেযুগের শিল্পী রূপচাঁদ পক্ষী গান বাঁধেন–


"গুলি হাড়কালি মা কালীর মত রঙ।

টানলে ছিটে বেচায় ভিটে যেন চুঁচুড়োর সঙ।।"


ree

অন্যান্য সামাজিক প্রথার মতোই কিছু শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এখনো ইষ্টদেবতার পরম সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ার এই যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়াস, কোন এক অলীক বিশ্বাসের বুকে ভর দিয়ে, কখনো শূন্যে ভেসে অথবা শূন্য থেকে ঝাঁপ দিয়ে; সেসব কঠিন মনোবল ছাড়া সম্ভব হয়না। যাঁরা নিত্যদিন কঠিন পরিশ্রমের সাধনায় নিজেদের আবৃত রাখেন, বোধহয় তাঁদের পক্ষেই বোঝা সম্ভব হয় গলায় তীরবিঁধে ঈশ্বরের মর্ম।


ree

পরিশেষে হুতোমের দু-চার কথা quote-উক্তি না করলেই নয়...


"পাঠক! চড়কের যথাকথঞ্চিৎ নকশার সঙ্গে কলিকাতার বর্তমান সমাজের ইনসাইট জানলে, ক্রমে আমাদের সঙ্গে যত পরিচিত হবে, ততই তোমার বহুজ্ঞতার বৃদ্ধি হবে..."


ree

ব্যোম ভোলে!

 
 
 

Comments


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page