top of page

প্যাঁচা পুতুলের দেশে

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Jul 24, 2020
  • 4 min read

Updated: Jul 26, 2020



একটা আস্ত গোটা ছুটির দিন...যাকে চট করে ওত সহজে পাওয়া যায়না। চার বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়, অবশ্য পেলে একবার তাকে কেন্দ্র করে কত দূরদূরান্ত যাওয়া যায়, তার একটা আকাঙ্খা থাকে মনে। দিনটা ২৯শে ফেব্রুয়ারি। কী আহ্লাদ! এমন একটা দিনকে স্মৃতিবহুল করে রাখতে গেলে একটা নতুন জায়গায় যাবার খুব দরকার। জায়গা মানে তো আমার কাছে গ্রাম, নতুনগ্রাম।তাই কটা বিস্কুট, চিড়ে, মুড়ি সঙ্গে নিয়ে সোজা মেট্রো ধরে দমদম,তারপর কাটোয়া লোকাল, গন্তব্যস্থল অগ্রদ্বীপ স্টেশন। একবার ট্রেনে উঠে পড়লে এন্টারটেন্মেন্টের কোনো শেষ নেই। আশেপাশের লোকজন বুঝতেই দেবেনা আপনাকে, আপনি একা যাচ্ছেন না দোকা। এইভাবে কখন যে ৩ ঘণ্টা কেটে গেল, বুঝলামই না। নেমে অটোয় উঠে বললাম, কাঠের পুতুলের মিস্ত্রিপাড়া যাব। দশ টাকা ভাড়া দিয়ে হালকা মেঠো পথ ধরে ক্রমে সবুজের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলাম। অটো থেকে নেমে যে রাস্তাটা দিয়ে মিস্ত্রিপাড়ার ভেতর ঢুকতে হয়, তার দু’পাশটা সবুজে সবুজ।


মেঠো পথে ঢাকা সবুজ একটা গ্রাম, যার নাম নতুনগ্রাম


পাড়ার ভেতর ঢুকে একের পর এক বাড়ি, ছোট্ট ছোট্ট গলিপথ বেয়ে। সবকটা বাড়িতেই কাজ চলছে। রাস্তার ওপর কাঠ কাটা ও ছাঁটার কাজ করে চলেছেন পুরুষেরা। এরপর একটু ভেতরের দিকে বসে মাটির প্রলেপ দিচ্ছেন মহিলারা, তার ওপর কাগজ সেঁটে দিচ্ছেন যাতে মাটি আটকে থাকে কাঠের ছাঁচের গায়ে। এর পরের স্টেপটা সময়সাপেক্ষ। যতক্ষণ না রোদে ভালো করে শুকিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ রঙের কাজ শুরু করা যাবেনা। তবে এরপরেই শুরু হয় আসল খেলা।


কাঠের ছাঁচের ওপর মাটির প্রলেপ দেওয়া চলছিল তখন


কাঠের ছাঁচ থেকে রঙিন পুতুল হয়ে ওঠার গল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে, প্রায় প্রতিটা পরিবারের আট থেকে আশি সকলেই সামিল। সারাদিন ধরে ছোট বড় মিলিয়ে কয়েক হাজার পুতুল তৈরি হয় প্রতিদিন এখানে। যদিও বেশীরভাগই প্যাঁচা, তবে এর মধ্যেও রকমফের আছে। এছাড়া, কৃষ্ণ, নিতাই গৌর, জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা, ছোটবেলার খেলার সেই রাজা রানী, কিংবা বাঁশি, একতারা সবকিছুই আছে এদিক সেদিক মিশিয়ে মিলিয়ে। তবে এগুলো তো সবই কম সময় সাপেক্ষ কাজ। বেশ কিছু বাড়িতে তৈরি হচ্ছে কাঠের আসবাবপত্র। কী অসীম সাধনা আর ধৈর্যের কাজ, তা না দেখলে বোঝা যাবেনা। একটা বাড়িতে দেখলাম লম্বা দরজার সাইজের কাঠের খোদাই করা দুর্গা বানানো হচ্ছে, অর্ডারের মাল। কলকাতায় যাবে। জানিনা, এঁরা কত টাকা মজুরি পাবেন, তবে দক্ষতা আর নিপুণতায় যে শিল্পকর্ম এনারা করে চলেছেন অবিরত, তার কোন তুলনা নেই।


সেই মহিষাসুরমর্দিনী, যা বহু নিষ্ঠার ফসল


এঁদের প্রত্যেকেই অর্ডার অনুযায়ী কাজ করেন এবং বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থাও করেন। গোটা গ্রাম জুড়ে প্রায় ৫০-৬০ টি পরিবারে, রয়েছেন প্রায় ৩০০-৩৫০ শিল্পী। এমনকি অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরাও, প্যাঁচা কিংবা ছোট ছোট কাঠের পুতুল রঙ করতে সিদ্ধহস্ত।



বাালিকা তার নিজের খেলার পুতুল নিজেই বানিয়েছে, একটা রাজা-একটা রাণী


একটু করে এগোচ্ছি আর দেখছি, প্রত্যেকের ঘরেই কোনো বাধা-নিষেধ নেই প্রবেশের কিংবা ছবি তোলার। কিছু না কিনলেও সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে কেউ কেউ শুধু আপনার দেখার বা ছবি তোলার জন্য এবং এরা প্রতি মুহূর্তেই চায়, কীভাবে এঁদের কাজ আরও প্রচার পাক, পরিচিত হোক, দূরের মানুষের কাছে।


এক ঝুড়ি প্যাঁচা


বেলা একটু গড়াতেই ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম দিলীপ ভাস্করের বাড়ি। ওনার মুখ থেকে শুনলাম নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল তৈরির ইতিহাস। দিলীপ বাবু বললেন, ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজোতে যে প্যাঁচা-পেঁচীর ব্যবহার হয়, সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই মূলত ঘরে ঘরে প্যাঁচা তৈরির কাজ শুরু হয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে হরিপদ রায় চৌধুরী নামে একজন শিল্পী আসেন, যিনি মূলত উৎসাহ দেন ও শেখান কীভাবে কাঠের প্যাঁচা ছাড়াও পুতুল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বানানো যায়, এবং এই কাঠের পুতুল বানানোকে কেব্দ্র করে কীভাবে নতুন গ্রামকে হস্থশিল্পের কর্মস্থল করে তোলা যায়, সেই বিষয়ে নানান ভাবে সাহায্য করেন। এরপর শুরু হয় ঘরে ঘরে কাঠের পুতুল বানাবার প্রশিক্ষণ। ১৯৬৬ সালে, দিলীপ ভাস্করের বাবা শ্রী শম্বুনাথ ভাস্কর একটি রাবণ বানাবার জন্য রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত হন।তারপর থেকে বংশপরম্পরায় এই কাজ চলে আসছে। এখন সরকার থেকে করাতকলের ব্যবস্থা করায় ধৈর্য ধরে বসে বসে কাঠের ছাঁচ আর তৈরি করতে হয়না। তাই কম সময়ে কাজও বেশখানিকটা এগিয়ে যায়। দিলীপবাবু বর্তমানে, কলকাতার হেরিটেজ স্কুলে কাঠের পুতুল বানাবার ট্রেনিং দেন ছাত্রছাত্রীদের।নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে কিরকম প্রতিক্রিয়া পান জিজ্ঞাসা করাতে উনি বলেন, “ওরা খুব আগ্রহ সহকারে শেখে। যতটা পারে, বানানোর চেষ্টা করে, আর স্কুলের মাস্টাররাও খুব উৎসাহ দেন এদের এই কাজে।”


কাঠিয়া বাবার আশ্রম


দিলীপ বাবুর সাথে কথাবার্তা সেরে, গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে গিয়ে দেখে এলাম, কাঠিয়া বাবার তপোবন। ভিতরে রয়েছে মন্দির, আশ্রম, গো-শালা, খরগোশ, এবং একটি বিশালাকার ময়ূর। পরেরবার কেউ নতুনগ্রামে গেলে অন্তত ময়ূরটিকে দেখার জন্য একবার কাঠিয়া বাবার তপোবন থেকে ঘুরে আসতে পারেন।


এই সেই ময়ূর


তবে নতুনগ্রামে রুটি রুজির হাল বৃদ্ধি হয়েছে সাম্প্রতিককালে, যখন থেকে কলকাতার বিভিন্ন মেলায় এনাদের কাজকে তুলে ধরবার প্রচেষ্টা নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অবশ্য এ ক্ষেত্রে “বাংলা নাটক ডট কম” কে ধন্যবাদ না দিয়ে থাকা যায়না। প্রতি বছর বাংলার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন শৈল্পিক নিদর্শনকে তুলে ধরবার জন্য যে মেলাগুলি গোটা শীতকাল জুড়ে এনারা পরিচালনা করে থাকেন, তার মধ্যে “কাঠ পুতুলের মেলা” অন্যতম। যদিও আজকাল সারাবছরই মানুষ আসেন এদের কাছে এবং কমবেশী টুকটাক জিনিস কিনে নিয়ে যান বা অর্ডার দেন, যার ফলে বর্ষার সময় এদের সংসারে এখন আর আগের মত টান পড়েনা। তবে, এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং হস্ত শিল্প মেলা ইকো পার্কে স্থানান্তরিত হওয়ায় আগের মতন সেরকম বিক্রি-বাটা হচ্ছেনা এবং বহু সামগ্রী ফেরত নিয়ে চলে আসতে হচ্ছে বলে জানান, বেশ কিছু শিল্পীরা। বেশ কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের রুরাল ক্রাফট অ্যান্ড কালচারাল হাবস এর পক্ষ থেকে নতুনগ্রামে পর্যটকদের জন্য থাকবার একটি ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেশ সুন্দর, ছিমছাম, ভেতরে একটি মিউজিয়ামও আছে। তবে মেলার সময় এবং শীতকালে গিয়ে থাকতে চাইলে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভাল,নাহলে থাকবার জায়গার অভাব ঘটে।


চক্ষুদান পর্ব মায়ের হাতে


অভাব আছে, অভাব থাকবেই। অভাবকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যাওয়া প্রতিটা দিন। তবে যেটা আছে এনাদের মধ্যে তার নাম, ভালোবাসা আর আতিথেয়তা, যার জন্য সারাটা দিন একবারের জন্যেও মনে হয়নি আমার যে আমি একা গেছি। কেউ ডাকছেন চা খেতে, কেউ ডাকছে্ন ভাত খেতে। শেষমেশ এক দিদা বলেন, “তাহলে মুড়ি মেখে দি? গাজর, শশা, পেঁয়াজ কুচি আর কড়াইশুঁটি দিয়ে?” আমি বললাম, “তাই দাও”। তারপর জিনিসপত্র গুছিয়ে টোটোয় তুলে দেওয়া জনা ছ-সাতেক কচিকাচা মিলে হৈ হৈ করে। ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল, আমি বোধহয় আমার গ্রামের পরিবারকে ফেলে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি শহরের পরিবারের দিকে। এখানে হয়ত আবার আমকে ফিরে আসতে হবে, কিছু না কিনলেও এই মানুষ গুলোকে দেখতে, এদের ভালবাসার টানে।


পড়ন্ত আলোর ছটায়


এক হাতে মুড়ি,অন্য হাতে শিঙাড়া, ব্যাগ ভর্তি প্যাঁচা, পুতুল আর মনের কোণে চিনচিনে একটা ব্যথা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে। বিকেল চারটে পঁয়তাল্লিশের জঙ্গিপুর মেমু। সবুজ ঘাসের ওপর তখন হলুদ আলোর ঝিকিমিকি। শেষ বিকেলের এই মুহূর্তটা আমায় বরাবরই মায়ায় জড়িয়ে রাখে, যেখান থেকে ফেরত আসাটা কঠিন হয়ে পড়ে, ক্রমশ কঠিন। সময়টা কাটতে চায়না। একটা গল্প মনে মনে ফাঁদ পাততে থাকে, ঘুম এসে যায় চোখে, পেট ভরা আদরের ঘুম...


পুতুল গ্রামের তুলির টানের জাদুভরা সম্পদেরা

 
 
 

Comments


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page