পলাশবন
- Shrabanti Mitra
- Feb 28, 2021
- 3 min read

“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা আজকে চৈত্র মাস/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলে আমার অবকাশ”...

অদ্ভুতভাবে, যতদিন প্রকৃতি রঙিন থাকে, ততদিন আমার ঘরে মন টেকে না। তার ওপর সেই গত বছর থেকে অপেক্ষা করে আছি, পলাশবন যাব, পলাশবন যাব।

প্রতিদিনই গড়ে অন্তত দুটো করে পোস্ট দেখছি, মনে ক্ষীণ দুশ্চিন্তা কাজ করছে, লোকজন যেভাবে পলাশের ডাল উপড়ে নিচ্ছে, তাতে কতদিন আর পলাশ ফুলগুলো সতেজ থাকবে, এদিকে ছুটির দিন ছাড়া যাবার জো নেই।

অগত্যা, রবিবারের ভাত-ঘুম ভুলে মেট্রো ধরে গেলাম এসপ্ল্যানেড, বাস ধরে গেলাম হাওড়া, ট্রেন ধরে গেলাম বেলুড়, আর টোটো ধরে গেলাম ই. এস. আই হসপিটাল।

এসব পথ নির্দেশনার গল্প তো আপনাদের সকলেরই জানা। তাই, টোটো থেকে নামার পর টোটোওয়ালাকে, “দাদা পলাশবনটা কোনদিকে?” জিজ্ঞেস করতে গিয়ে খানিক সংকোচ আর লজ্জিত বোধ করলাম। টোটোওয়ালা বললেন, “ঐ তো যান যান, সোজা ওদিকে, সবাই যাচ্ছে”। বুঝলাম, ব্যাস লাইন পড়ে গেছে। এবার বসন্ত উৎসব শুরু হতে চলল বলে।

গিয়ে দেখি, যা ভেবেছি তাই। কামানের মত লম্বা লম্বা লেন্স, ললনা, ষোড়শী থেকে শুরু করে আট থেকে আশি কেউ বাদ নেই। কত দূর দূর থেকে এসেছে সবাই...

পাশ দিয়ে কয়েকটা ছেলে বলতে বলতে গেল, “দেখ, আমাদের পাড়া, আমরাই জানতাম না কিছু, বাইরে থেকে লোকজন এসে ডিসএলার দিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছে, আমিও পরের বার একটা ক্যামেরা কিনে, ছবি তুলব, আর ফেসবুকে দেব।” আমার চোখ আর কান কিছুই এড়ায় না, যে যা বলে সব মনে থাকে।

বসন্তের অতিথি

যাইহোক, যত ভেতরে ঢুকছি তত ভাবছি, কার ছবি তুলব আর কিসের। গাদা গাদা পলাশ, প্যাকেটে প্যাকেটে ভরে উঠছে। অন্যদিকে, এক শ্রেণীর রাবীন্দ্রিক সম্প্রদায়ভুক্ত মহোদয়গণ, সূচ, সুতো সহকারে লাল ও হলুদ পলাশের সংমিশ্রণে অসীম ধৈর্য ও নিপুণ দক্ষতার সাথে একের পর এক মালা গেঁথে চলেছেন এবং অতি উল্লসিত হয়ে “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়, আজ দখিন দুয়ায় খোলা” ইত্যাদি গান গেয়ে চলেছেন। যার ফলে, বিকেলের মৃদু মন্দ বাতাসে যাও দু-একখানি পাখী চাক্ষুষ দেখার সুযোগ ছিল, তাও উল্লাসে মুখর হয়ে পশ্চিমে ধাবমান হল।

ধীর পদক্ষেপে ক্রমে জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করলাম। এক গোছা হলুদ পলাশের দিকে ক্যামেরাটা তাক করেছি যেই, ওমনি পেছন থেকে এক ভদ্রলোক বললেন, “ওখানে কিন্তু কেউটে আর চন্দ্রবোড়া আছে।” আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “ও আচ্ছা।” এরপর দুরু দুরু বক্ষে আর কম্পমান পায়ের উৎকণ্ঠায় দু’চার খানা ক্লিক ক্লিক করেই দ্রুত গতিতে লোকালয়ের দিকে অগ্রসর হলাম।

এসে দেখি, আট দশটা ছেলে-ছোকরা গাছের ডাল ধরে ঝুলছে, এবং তাই দেখে তিন চার জন চল্লিশোর্ধ ভদ্রলোক হাঁ করে তাকিয়ে আছেন, আর নিজের বউকে বলছেন, “দেখ, দেখ, ছেলেপুলেগুলোর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, এই যা গিয়ে পড়তে বস”। কী জানি! ওনার ছোটবেলার দস্যিপানার কথা হয়ত মনে পড়ে গেছিল, আর এসব দেখে খানিকটা ইয়ে হয়ে পড়েছিলেন, তাই বেচারাদের খেলার মাঠ ছেড়ে পড়তে পাঠাচ্ছিলেন।

যাইহোক, এসব দেখেশুনে দেখি, লাল আর হলুদ পলাশের মাঝখানে লাল টকটকে শিমূল দেখা যাচ্ছে। কী আনন্দ হল! নীল আকাশের নীচে, লাল শিমূল।

পাশ থেকে এক ভদ্রমহিলা তার বান্ধবীকে বললেন, “ঐ দেখ, ওটা রুদ্রপলাশ।” এটা অবিশ্যি আমি জানতাম যে, বাঙালী বরাবরই কনফিউসড, শিমূল আর রুদ্রপলাশের মধ্যে। তাই তেমন গা’ না করে এগিয়ে চললাম।

গোটা জঙ্গলের পথে পথে পলাশ ছড়ানো। মাঝে মধ্যে সত্যিই অবাক লাগছিল ভেবে যে, এত কাছাকাছি, সত্যিই এরকমটা হতে পারে! এক পরিবারের লাইন দিয়ে পরপর পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলা হয়ে যাবার পর, একটা ডালের দিকে এগোলাম। থোকা, থোকা ফুল! সূর্যের আলো এসে পড়ছে তার ওপর। দেখেই মায়া লাগছে!

কেউ কেউ আবার বাড়ির টবের জন্য ডাল শুদ্ধু তুলে নিয়ে যাচ্ছেন, আর লালমোহন বাবুর মতন করে স্ত্রীকে বলছেন, “ওই দেখো, পেয়িচি, পেয়িচি”।

একটু দূরে একটা উঁচু ডালের ওপর দোয়েল না মাছরাঙা কী যেন একটা বসে আছে। সন্তর্পণে ক্যামেরা তাক করতে যাব, এমন সময় ওদিক থেকে গলা ছেড়ে, “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, মনে মনে”… হ্যাঁ, পাখীর মনেও তাই। সে কেন গাছের ডালে, আমরা জন্য চুপটি করে বসে থাকবে। তাই, সেও ফুড়ুৎ।

এইসব গোলযোগে, দুম করে সন্ধ্যেটা নেমে গেল। আশপাশটা ঘন নীল রঙে ছেয়ে গেল। কোকিলের কলতানে সঙ্গীতমুখর হয়ে উঠলো পলাশবন। আর আমি ক্যামেরা গুটিয়ে গা-হাত-পা চুলকোতে চুলকোতে টোটো স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে লাগলাম।

পরিশেষে, আরও খানিক বাড়তি না হেজিয়ে আর পারছিনা। ভদ্রমহোদয়গণ, আগামী বছরগুলোয় বেলুড়ের পলাশবনকে প্রাকৃতিক চেহারায় দেখার যদি ইচ্ছে থাকে, তাহলে দয়া করে-
১) পলাশের ডাল ছিঁড়বেন না, ২) জোরে চিৎকার করে কথা বলবেন না, ৩) প্ল্যাস্টিক ফেলবেন না।
এতে, আমাদেরই পরের প্রজন্ম পলাশবনে গিয়ে একটু প্রাকৃতিক শান্তি পাবে।

পুনশ্চঃ ফেরার সময় বেলুড় মঠ গেছিলাম। গিয়ে শুনি, ওখানে একটু আগে আরতি দেখাবার নিধেয়াজ্ঞা জারি হয়েছে কোরোনা ভাইরাসের কারণে। ব্যাস, তারপর থেকে আমিও কোয়ারেন্টাইনে বন্দী হয়ে গেলাম। এখন মনের ভিতর আওড়াই, “প্রহর শেষের আলোয় রাঙা আজকে চৈত্র মাস/ ফুলের নাম মহুয়া হলে, নেশার নাম পলাশ”...

ঘাসের উপরে ছড়িয়ে থাকা শিউলি আর গাছে ফুটে থাকা পলাশ, এই দুটি দৃশ্যই আমার বড় প্রিয়। শৈশবের একটুকরো ছবি দেখে খুব ভালো লাগলো। শহর থেকে এই দৃশ্য হারিয়ে গেছে।