বীরভূমের রাজধানীতে
- Shrabanti Mitra
- Jul 17, 2021
- 4 min read

যে কোন জেলাই তার সামগ্রিক বৈশিষ্ট নিয়ে গড়ে ওঠে, তারপর নিজের মত করে ছড়িয়ে যায় যেদিকে বেশী স্বাধীনতা পায়। যে কোন জেলাতেই মাটির টান বা শেকড়ের টান শব্দটা বড় হয়ে দাঁড়ায়, যখন সেটা তার অস্ত্বিত্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় তাকে। অনেকটা রাজনীতি, আরও অনেকটা অর্থনীতি কিংবা আরও অনেকটা ব্যবসায়িক বৃদ্ধি, এ সব কিছুর ঊর্ধে যেটা দাঁড়িয়ে থাকে আর দাঁড় করিয়ে রাখে, বিশাল এক মানবজীবনকে তার নাম সম্ভবত “ভালোবাসা”। আর এই ভালবাসার জন্যেই বোধহয় গোটা বীরভূমে ভৌগলিক, প্রাকৃতিক ও আঞ্চলিকগত বিশাল বৈচিত্র্য, থাকার পরও আমরা ছুটে ছুটে যাই বারবার সেই শান্তিনিকেতনেই।

বোলপুর কবে যে শান্তিনিকেতন হয়ে উঠল, বাঙালীর ঘরে ঘরে, সেই গল্পটা আমরা অনেকেই জানি। তবে কোন সেই অমোঘ টান, যার জন্য বছরের পর বছর ধরে কিছু না কিছু নতুন সৃষ্টির আনন্দে আমরা হুশ করে শান্তিনিকেতন পৌঁছে যেতে পারি অনায়াসে, তা ঠিক এখনো বলা যাচ্ছেনা। যার জেরে পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও আমাদের শেকড়টা আটকে থকে সেই শান্তিনিকেতনেই।

আমাদের এই ছোট্ট রাজধানীর রাজা, বহুদিন আগেই তাঁর রাজ্যপাট ত্যাগ করে দূরদেশে পাড়ি দিয়েছেন। যদিও সেই রাজমহলের রাজশাসন এখনো প্রবল পরাক্রমে জারি রয়েছে দিবারাত, তাও আমরা ক’টাদিন ভালো থাকবার কথা ভাবলেই আজও শান্তিনিকেতনে দৌড়ই।

আমার আজকের গল্পটা শুধুই গল্প। কারণ, আজ আমি কখন গেছিলাম, কীভাবে গেছিলাম, কোথায় থেকেছি, কোথায় কোথায় কি কি দেখা যায়, কীভাবে ফেরা যায় এসব কিছুই বলব না। কারণ, না বললেও এসব ডিটেলস আমরা সবার প্রথমেই জেনে যাই, যখন অন্য কোথাওই আর যাওয়া হয়না। এ দেশের এমনই মায়া! তাই আজ শুধু আমার সারাদিনের অনুভূতিগুলোর কথা লিখব প্রতিটা জায়গার সাথে সাথে।

একদিন হঠাৎ করে বেরিয়ে আবার হঠাৎ করে ফিরে আসার গল্প এটা। কিছু যখন ভালোলাগেনা, তখন চেনা জায়গায় অচেনা মানুষের মত ঘুরতে বেশ ভালো লাগে। তাই একটা মেঘলা পৌষের সকালে, বোলপুর স্টেশনে নেমে বল্লভপুর অভয়ারণ্যে গোটা ৫০ টাকার টিকিট কেটে হরিণের সাথে গল্প করতে ঢুকে পড়েছিলাম।

ওরা বেশ দূরে থাকায়, আমার কথাগুলো ইশারায় জবাব দিচ্ছিল। আর আমি এদিক-সেদিক চেয়ে ঝলসে যাওয়া আলোয় পাতাগুলোর দিকে ক্যামেরাটা তাক করতে করতে ভাবছিলাম, এটা আসলে ভীষণ ভালো প্রেম করবার জায়গা। পৌষের গাঢ় শীতে ঝরে যাওয়া পাতা আর মেঘ-রোদ্দুর মিলে, আলগোছে খুনসুটি করবার জায়গা।

এখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের ভিতর। একটা ফর্মালিটি তৈরি হয়েছে এখানে। ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতিতে কৃত্রিমতার ছাপ স্পষ্ট। তাও, পুনশ্চ, কোনার্ক, উদীচী, শ্যামলী আর উদয়ন এর মাঝে কিংবা নথি, ছবি, কলম, কাগজ আর ওই বিশাল মাঠটার মাঝে কোথাও একটা বেঁচে থাকা রয়েছে, সৃষ্টি রয়েছে, রয়েছে প্রতিটা পদক্ষেপে প্রাণের আনন্দ।

বিশ্বভারতীর ভেতরে গুরুদেবের বাড়িগুলোয়

এই বা কম কি? আজকের এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে! গুরুদেবের বাড়িগুলো ঠিক তাঁর সাদামাটা ঢঙটাই ধরে রেখেছে আজও। বাগানের ফুলগুলো সুবাতাস, আর আদর পেয়ে পেয়ে বেশ আহ্লাদী হয়ে উঠেছে। এলোমেলো ছায়ারা পছন্দসই বটবৃক্ষের তলায় গুছিয়ে নিয়েছে নিজেদের। লম্বা লম্বা হাত পা ওলা মানুষগুলো যে যার মত ছড়িয়ে আছে ছাতিমের গন্ধ মাখা, রাজপ্রাসাদের আনাচে-কানাচে। আমার কাছে আজও বিশ্বভারতী কোন মহাপ্রাসাদের শৈল্পিক সংস্করণের মত লাগে।

অন্দরসজ্জা ও বাহিরসজ্জা

এখান থেকে বেরিয়েছি যখন বেলা প্রায় গড়িয়ে গেছে, তাই খাওয়াদাওয়া সারতে গেলাম বোলপুরের শ্রীনিকেতন মোড়ের কাছে অতি প্রাচীন পাইস হোটেলে, যার নাম মহামায়া হোটেল। লাল রঙের সাইনবোর্ডে লেখা ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত, এই হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য।

এখানে মাছ ভাত ১০০ টাকা সঙ্গে রয়েছে ডাল, তরকারি, চাটনি, পাঁপড়। লম্বা বেঞ্চ পাতা, এদিক-ওদিক মিলিয়ে লাইন দিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে খাবার। ভাত…ভাত…ভাত…ভাত,ডাল…ডাল…ডাল, ঠিক যেন আগেকারের বিয়েবাড়ির মত। পাত বেড়ে খাওয়ানোর ভঙ্গিমাটা দেখে বেশ আনন্দ হল, আর সব খাবারই বেশ সুস্বাদু।

খোয়াইয়ের দেশে

খেয়ে-দেয়ে মৌরি চিবোতে চিবোতে এগোতে লাগলাম সোনাঝুরির হাটের দিকে। সেই চিরপরিচিত হাট, যার সঙ্গে আমবাঙালী অটুট বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে প্রতি শনি ও রবিবার। এখান থেকে জিনিসপত্র না কিনতে পারলে আমাদের সারাবছরের শপিং কমপ্লিট হয়না, মনটাও কেমন খচখচ করে।

সেসব যাইহোক, খোয়াইয়ের পুরনো হাটটা দেখলাম, এখনো বেশ সুন্দর আছে নতুন হাটের থেকে। নতুন হাটে, ভিড় বেশী, দামও বেশী। তাই খোলামেলায় দুপুরের আকাশটা যতক্ষণ নীল থাকে, গাছের পাতাগুলোর সবুজ রঙ যতক্ষণ উজ্জ্বল দেখায়, ততক্ষণ এই হাটবাজারে বিক্রি হওয়া শাড়ি, গয়না, মাটির দুল, কাঠের চুড়ি, একতারা, বাউল গান, বটুয়া ব্যাগ, সাঁওতালি নাচ সবকিছুই বড় রঙিন আর স্বতঃস্ফূর্ত মনে হয়।

আহারে-বাহারে

কিন্তু এই সব কিছুর শেষে খোয়াইয়ের ওপারে “সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি”...তখন আলোর নীচে জমে থাকা ধুলোধুসরিত অন্ধকারের মধ্যে গভীর চাপানউতোরের শব্দ পাওয়া যায়, শালবনের মর্মর দুলুনির মাঝে মাঝে। খানিকটা সোনাঝুরির সোনার মতো উজ্জ্বল হাটে বেচাকেনা করা মানুষগুলোর চাউনির মত। কত আশা নিয়ে তারা বসে প্রতি সপ্তাহন্তে, সেসব আশা তাদের কতখানিই বা পূরণ হয়, আমরা কী তার খবর রাখি?

শিল্পীরা

এই যে মানুষগুলো, যারা কোমর বেঁধে নাচে, মাদলের তালে তালে, কিংবা যে লোকটা ঘুরে ঘুরে তার জং ধরা দোতারায় সেই চেনা সুরটাকে বারবার গেয়ে গেয়ে নিজের কষ্টটা বোঝাতে চায় সবার কাছে, তার ঝুলিতে ক’ পয়সা ভরে রোজ? রোজ একই গান গাইতে, আর একই সুরে নাচতে কি ভালোলাগে কারো? “কিছু দেখি কিছু দেখতে পাইনা, কিছু বুঝি কিছু বুঝতে পারিনা...”

যদ্দিন জ্ঞ্যন, তদ্দিন গান...

সোনাঝুরি থেকে খানিক এগিয়েই প্রকৃতি ভবন। প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের উদ্যানে ঘেরা এই গোটা বাড়িটা। ভাবনাকে যেমন ছবিতে প্রকাশ করাটা একটা স্বাধীন আটপৌরে মাধ্যম, তেমনই ভাবনার প্রাকৃতিক রূপটাকে কেটে-ছেঁটে, তাকে বিমূর্ত রূপ দেবার একটা ব্যতিক্রমী প্রকাশভঙ্গী হল এই ভাস্কর্যগুলো।

দুটো গাছকে দূর থেকে একসাথে দেখলে অনেক ভাবনা আসে আমাদের মাথায়, আবার একটা মরা গাছের ফোকলা কোটর দেখে কত সময় কতকিছুর সাথে মিল খুঁজে পাই আমরা।

এখানে শেকড়-বাকড়, কাঠের গুঁড়ি কিংবা পাথরখণ্ডে সৃষ্টি হওয়া প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের রূপগুলো আর তাকে দেওয়া নামগুলো, তাই শিল্পীর নিজের চেতনার রঙে সাজানো, এর সাথে আমার-আপনার ভাবনার মিল নাও হতে পারে।

বিকেলের আলো যখন নীলচে হচ্ছে একটু একটু করে, তখন হাঁটতে হাঁটতে আদিবাসী গ্রামের দিকে এগোতে লাগলাম।

সাঁওতালদের কচিকাচাগুলো খেলছিল তখন রাস্তা জুড়ে। দু’পাশে রঙিন মাটির বাড়িগুলোতে তখন উঠোন পরিষ্কার করছে বাড়ির মেয়ে-বউরা। রাস্তার একধারে মাটির হাঁড়িতে হাঁড়িয়া বিক্রি হচ্ছে। আকাশে তাকিয়ে দেখি চাক বেঁধেছে বোলতা’রা। ঘোলাটে একটা হাওয়া থেকে থেকেই বয়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে। এদের বাচ্চাগুলো কত সহজে কুকুর-ছাগল ও আরও সব খুদে শাবকদের সাথে মিশে যেতে পারে! এদের কাছে এসব শাবকেরা তো পোষ্য নয়, পড়শি বটে! তাই এদের সাথে, বাচ্চাগুলোর দিনরাত লুকোচুরি, মারামারি আর আদর লেগেই থাকে। গোটা গ্রামটা জুড়ে এখনো যে সাদামাটা উজ্জ্বল ভাবটা চোখে পড়ল, সেটা কোথাও, শান্তিনিকেতনের এই বিশাল আড়ম্বর আর মেলার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে যেন! কৃত্রিম আলোর রোশনাইটুকু, রাঙা মাটির এই পথগুলোকে কংক্রিট করে দেয়নি এখনো। তারা বেশ ভালোই আছে তাই।

এসব দেখে শুনে বাড়ি ফেরাটা একটা মস্ত ঝক্কির কাজ মনে হয় আমার। যতটা ভাললাগা গড়ে ওঠে সারাটা দিন জুড়ে তিলে তিলে, সব কেমন যেন ভুস করে নিভে যায় ট্রেনটা ছেড়ে দিলেই। তবে, বাড়ির কাছে যে আরশিনগর’টাকে ছুটি কাটানোর অজুহাতের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলেছি আমরা একটু একটু করে, তাকে ফেলে চাইলেও বেশীদিন দূরে থাকা যায়না। প্রতিটা ঋতুই একবার করে ডিম্যান্ড করে শান্তিনিকেতন যাবার জন্য।

শান্তির নীড়

তাই অনেকেই ছড়িয়ে যাচ্ছে তার আশেপাশের ডেরাগুলোয়, থাকবে বলে, গাইবে বলে, হৈ হৈ করে বাঁচবে বলে। তবে, গ্রামটা যেন গ্রামই থাকে আর শহরটা শহর। তবেই না মজা, দুম করে ঠিক করে, হুট করে বেরিয়ে পড়ার। কাকভোরে, পায়ে পায়ে শান্তিনিকেতন…

দারুন , খুব সুন্দর লেখা 😊😊