top of page

বাংলার টেরাকোটার সম্পদ অনন্ত বাসুদেব মন্দির

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Oct 4, 2020
  • 3 min read

ree

পশ্চিমবঙ্গে যতগুলি টেরাকোটার কারুকাজ সম্বলিত একরত্ন মন্দির রয়েছে তার মধ্যে হুগলীর বাঁশবেড়িয়ার অনন্ত বাসুদেব মন্দির নিঃসন্দেহে অন্যতম। তবে, এই হংসেশ্বরী কালী মন্দিরের যে গৌরবান্বিত জনপ্রিয়তা মানুষের কাছে, তার তুলনায় অনন্ত বাসুদেব মন্দির কিছুটা ম্লান। এর একটা কারণ, আমার মনে হয় হংসেশ্বরী মন্দিরে মানুষ যেভাবে দেবীর পুজো দিতে পারেন এবং দেবীকে দর্শন করতে পারেন, তা অনন্ত বাসুদেবের মন্দিরে সেভাবে পারেননা, কারণ মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করার অনুমতি পাওয়া যায়না সেভাবে। এছাড়া হংসেশ্বরী মন্দির যেহেতু বাইরে থেকে আসার সময় প্রথমেই বিস্তৃত জায়গা জুড়ে অবস্থান করেছে, তাই অনেকেই তার পিছনে লুকিয়ে থাকা এই মন্দিরটিকে ভালভাবে দেখতে পান না এবং দেখলেও পুরো কমপ্লেক্স জুড়ে হংসেশ্বরী মন্দিরের নাম যেভাবে সবার কাছে অনায়াসেই পৌঁছয়, ঠিক সেভাবে অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের নাম সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয় না।


ree

অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের ভিতর থেকে বাইরের শোভা


তবে, বাংলার টেরাকোটা স্থাপত্যের ইতিহাসে এই মন্দির জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সৌধ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। তাই টেরাকোটার কাজের বিশেষজ্ঞদের কাছে, এটি একটি অমুল্য সম্পদ ও চর্চার বিষয়।


ree

অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের উপরিভাগের টেরাকোটার কারুকাজ


এই মন্দির গড়ে উঠেছিল হংসেশ্বরী মন্দির তৈরীরও বেশ কিছু বছর আগে। আদি বর্ধমানের অন্তর্গত পাটুলি থেকে এসে বংশবাটীতে(বর্তমান নাম বাঁশবেড়িয়া) রাজধানী স্থাপন করার পর, রাজা রামেশ্বর রায় ১৬৭৯ সালে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।


ree

টেরাকোটার কারুকাজের বিশেষ রুপ


ইটের তৈরি চারচালা কাঠামোর উপরে, একরত্ন বিশিষ্ট এই মন্দিরটির শিখরের রত্ন বা চূড়াটি অষ্টকোণাকৃতি। উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত, এই চারকোনা মন্দিরের তিনদিকে রয়েছে তিন-খিলান শোভিত অলিন্দ। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকার প্রবেশদ্বার দু’টি, যেখানে রয়েছে পাথরের তৈরি বাসুদেবের মূর্তি। চারহাত বিশিষ্ট এই মূর্তির হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম এবং বাঁ দিকের কোণে নারায়ণ ও ডান দিকের কোণে লক্ষ্মী।


ree

পৌরাণিক কাহিনীর নিদর্শন মন্দিরের গায়ে


মন্দিরটি অতি প্রাচীন হওয়ার ফলে, কালের নিয়মে অনেকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও, যা অবশিষ্ট আছে সেগুলির সৌন্দর্য ও শিল্পসুষমা চমকপ্রদ এবং বিশ্লেষণযোগ্য। জানিনা এই মন্দির কোন মহান শিল্পীর হাতে গড়া, তবে টেরাকোটার কাজের একেকটা প্যানেলে যে অসামান্য পৌরাণিক ও সামাজিক চিত্রসমূহ তুলে ধরা হয়েছে, তা দেখে খুবই কৌতূহল হয় এবং জানতে ইচ্ছে করে যে কোন ভাবনা থেকে এই মন্দির গড়ে তোলা হয়েছিল।


ree

পোড়ামাটির ফলকের ওপর পৌরাণিক কাহিনীর চিত্রায়ন


মন্দিরের গায়ে চতুষ্কোণ মাপের ছোট ছোট ইটের উপর, খুবই নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ও নানান পৌরাণিক কাহিনীচিত্র, যার মধ্যে রয়েছে দক্ষযজ্ঞ, মহিষাসুরমর্দিনী, দশমহাবিদ্যা, রাম-রাবণের যুদ্ধ, বিষ্ণুর দশাবতার, রাসলীলা, নৌকাবিলাস ইত্যাদি। এছাড়াও পোড়ামাটির ফলকের ওপর রয়েছে নৌকায় সিপাহী, অশ্বারোহী সৈনিক, বন্য জীবজন্তু, সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুক, যুদ্ধের দৃশ্য ইত্যাদি বিবিধ সামাজিক বিষয়ের উপর নির্মিত পোড়ামাটির চিত্র।


ree

এখনো যা কিছু ইতিহাস বেঁচে রয়েছে মন্দিরের সূক্ষ্মতায়


১৯০২ সালে বাংলার তৎকালীন ছোটলাট স্যার জন উডবার্ন এই কারুকার্যখচিত টেরাকোটার মন্দির দেখে খুবই প্রশংসা করেন। শোনা যায়, সেসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মন্দিরের টেরাকোটার সুক্ষ কারুকাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর ছাত্র নন্দলাল বসুকে এখানে পাঠান এবং তিনি একমাস ধরে মন্দিরের টেরাকোটা ফলকগুলি নিজের হাতে আঁকেন। বর্তমানে মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলে এলেও, মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখনও রাজবাড়ির সদস্যদের তত্ত্বাবধানেই রয়েছে।


ree

অশ্বারোহী সৈনিক


এই মন্দিরের ঠিক বিপরীত দিকে রয়েছে রায় পরিবারের বিশাল বাড়ি। এখানে এখনো এই পরিবারের সদস্যরা বসবাস করেন। হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রবেশপথের ঠিক আগেই বাঁ দিকে রয়েছে এই বাড়ির প্রায় ধসে পড়া নহবতখানা।


ree

রায় বাড়ির পুরনো নহবতখানা


তাহলে, কোথাও গিয়ে বোঝা যাচ্ছে, এই মনিমুক্তখচিত সমৃদ্ধশালী মন্দিরকে আরও বেশী করে রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং মানুষের কাছে এই মন্দিরের পরিচিতি বাড়ানোর বিশেষ প্রয়োজন। রাজা নৃসিংহদেব হংসেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ই দেখেছিলেন, বাসুদেব মন্দির ক্ষয় হচ্ছে, তাই তিনি পাথরের মন্দির বানাবার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর কত বছর কেটে গেছে। এখনো আমাদের চোখে এই মন্দির, বাংলার অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় খানিকটা অক্ষত। তবে, টেরাকোটার মন্দিরের সামাজিক গুরুত্ব যতটা, তাকে রক্ষা করতে গেলে সরকার ও রায় পরিবার- দুই তরফ থেকেই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ চালিয়ে যাওয়া খুবই জরুরী।

ree

টেরাকোটার একেকটি প্যানেল ইতিহাসের একেকটি দৃষ্টান্তের সাক্ষ্য বহন করে


বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ

· সরাসরি বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে নেমে অনন্ত বাসুদেব মন্দিরে যেতে চাইলে হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকালে উঠতে হবে। বাঁশবেড়িয়া স্টেশন থেকে টোটোতে অথবা হেঁটেও পৌঁছে যাওয়া যায় অনন্ত বাসুদেব মন্দির।

· এছাড়া হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল স্টেশন নেমে অটো অথবা বাসে অনন্ত বাসুদেব মন্দির পৌছনো যায়। ফেরার সময়ও ওই একি ব্যাপার।

· বাঁশবেড়িয়ায় কার্ত্তিক পুজো খুবই বিখ্যাত। এই সময়ে ওখানে গেলে বিশেষ করে, কিছু পুরনো বারোয়ারী পুজো দেখতে অবশ্যই পরামর্শ দেব। সে গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।

· বাঁশবেড়িয়ায় বেশ কিছু পুরনো বনেদী বাড়ি রয়েছে। তাই শুধু মন্দির দর্শন করে চলে না এসে, আশেপাশের জায়গাগুলো একটু চোখ বুলিয়ে এলে মন্দ লাগবেনা আশা করি।


ree

 
 
 

コメント


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page