মাতৃরুপে হংসেশ্বরী
- Shrabanti Mitra
- Sep 26, 2020
- 4 min read
Updated: Oct 4, 2020

যে কোন ধর্মীয়স্থান যখন শুধু ভক্তের সমাগমের কারণে জনপ্রিয় না হয়ে উঠে, তার অবস্থানগত কারণের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন সেই স্থানের বা পরিবেশের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই বাড়তে থাকে যত দিন যায় এবং অবশেষে সেটি শীতকালীন একটি চড়ুইভাতির আদর্শ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ঠিক এমনটাই ঘটেছে, হুগলীর বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী কালীমন্দিরের সাথে।
একটা ট্রেন্ড কোথাও বাঙালির জীবনে ঢুকে পড়েছে। ব্যাপারটা খানিক এরকম যে, শীতকাল এলেই যেখানে যত লোক আছে, সবাই দল বেঁধে ওই ২৫শে ডিসেম্বর নাগাদ প্রথমে যায় হংসেশ্বরী মন্দির, তারপর ব্যান্ডেল চার্চ, তারপর ইমামবাড়া। এ যেন হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান এই তিন ধর্মের ত্রিবেণী সঙ্গম, যার সবটুকু যেমন করে পারা যায় চোখ বুলিয়ে, খানিক ভোজন আর সেলফি ইত্যাদি সেরে ফের যে যার কোটরে ঢুকে পরবার পরম শান্তি। এভাবে মন্দির-মসজিদ-গির্জা দর্শন হলেও, এগুলোর গড়ে ওঠবার পিছনের গল্পটা আমাদের অজানাই থেকে যায়। যে জায়গা থেকে কয়েকদিন আগে খানিকক্ষণের জন্যে বেড়িয়ে এসেছিলাম, সেই জায়গাগুলোই কত অজানা ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তার খবর পাইনা। আজ সেরকমই একটি অতিপরিচিত স্থানের গোড়ার গল্প বলব।

হংসেশ্বরী মন্দিরের কারুকাজ
বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী কালীমন্দির পশ্চিমবঙ্গের এমনই একটি বিরল স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ, যা সচরাচর বাংলার মন্দিরে দেখা যায়না। সাধারণত, চালা বা রত্ন স্টাইলের ওপর পোড়ামাটির কাজের যে যে মন্দির বাংলার স্থাপত্য নিদর্শনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে হংসেশ্বরী মন্দির একেবারেই একটি ব্যতিক্রমী ধারায় গড়ে উঠেছে। উত্তর রাজস্থানের শেখাওয়াতি হাভেলি নির্মান শৈলীর ধাঁচে তৈরি হয়েছে এই মন্দির। মন্দির গড়ে তোলবার পিছনে অবদান রয়েছে এক জমিদার তন্ত্রসাধকের।
আদি বর্ধমানের অন্তর্গত পাটুলিতে বসবাস করতেন রামেশ্বর রায়ের পরিবার। তার পরবর্তীকালে তাঁরা রাজধানী স্থাপন করেন বংশবাটীতে, যার বর্তমান নাম বাঁশবেড়িয়া। রামেশ্বরের পুত্র ছিলেন রঘুদেব আর রঘুদেবের পুত্র গোবিন্দদেব, যিনি মারা যাবার তিন মাস পর জন্ম হয় গোবিন্দদেব আর হংসেশ্বরী দেবীর পুত্র নৃসিংহদেবের। নৃসিংহদেব বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে দেখেন তাঁর পিতার অকাল মৃত্যুর ফলে তাদের জমিদারির বেশ কিছু অংশ হাতছাড়া হয়ে গেছে ব্রিটিশ সরকারের কাছে। পরে ওয়ারেন হেস্টিংস ও লর্ড কর্নওয়ালিসের বদান্যতায়, জমিদারির কিছুটা অংশ পুনরুদ্ধার করা গেলেও সম্পূর্ণ জমিদারি উদ্ধার করতে হলে লন্ডনে কোর্ট অফ ডিরেক্টরের কাছে আর্জি জানাতে হবে। এদিকে, নৃসিংহদেব সেসময়ে হঠাৎ কাশী চলে যান এবং সেখানে গিয়ে ১৭৯২-১৭৯৯ সাল পর্যন্ত তন্ত্রচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এই সময়ে একদিন রাতে স্বপ্নে তাঁর মাতৃরূপে দৈবদর্শন হয়। তাঁর নিজের মা হংসেশ্বরী দেবীকে দেখতে পান জগজ্জননী দেবীরুপে। এই স্বপ্নই তাঁর দিব্যচক্ষু খুলে দিয়েছিল, যার ফলে তিনি পরের দিনই স্থির করেন, যা টাকা আছে রাজকোষে, তা দিয়েই তিনি তন্ত্রমতে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন তাঁর মায়ের নামে, ফলত গড়ে ওঠে আজকের হংসেশ্বরী মন্দির।

হংসেশ্বরী মন্দিরে মায়ের পুজো
বংশবাটীতে ফিরে প্রপিতামহের তৈরী অনন্ত বাসুদেব মন্দিরটির ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থা দেখে তিনি ঠিক করেন, নাহ!আর পোড়ামাটির মন্দির না। এবারে তিনি পাথরের মন্দিরই বানাবেন। ফলে, কাশী থেকে কিনে আনেন সাত নৌকা চুনা-পাথর, উত্তরখণ্ড থেকে আনিয়ে নেন প্রস্তর শিল্পী, মন্দির তৈরির জন্য। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে ১৮০২ সালে মন্দিরের কাজ অসমাপ্ত দেখেই তিনি বিদায় নেন পৃথিবী ছেড়ে। এরপর ১৮১৪ সালে তার বিধবা স্ত্রী রাণী শঙ্করীদেবী নিজ দায়িত্বে মন্দিরের কাজ সম্পন্ন করেন।

রাজস্থানের শেখাওয়াতি হাভেলি নির্মান শৈলীর প্রতিচ্ছবি মন্দিরের স্থাপত্যে
হংসেশ্বরী মন্দিরটির স্থাপত্যকার্যে আনা হয়েছিল ২১ মিটার মিনারের রূপো এবং এর নির্মাণকার্যে খরচ হয়েছিল মোট ৫ লক্ষ টাকা। মন্দিরটি, ৭০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট দক্ষিণমুখী এই মন্দিরের চারিদিকে বারান্দা ও সামনে ইটের তৈরি বাঁধানো চত্বর রয়েছে। পাঁচতলা এই মন্দিরে মোট ১৩টি মিনার বা চূড়া রয়েছে। প্রতিটি মিনারের শীর্ষভাগ মোচাকৃতি পদ্মকোরকের আদলে নির্মিত। মাঝের মিনারটির নীচের তলায় সাদা রঙের একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। গোলাকার বেদীর ওপর পাথরের শিব মূর্তির নাভি থেকে উদ্গত, প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর নিম কাঠের তৈরি, হংসেশ্বরীরর এই প্রতিমাটি নীলবর্ণের। দেবীর বাঁহাতে খড়গ ও নরমুন্ড এবং ডানহাতে অভয়মুদ্রা ও শঙ্খ।

মহিষমর্দিনী মূর্তি
যেহেতু তন্ত্রমতে দেবীর পুজো হয় এখানে, তাই এই মত অনুসারে ‘হংস’ কি তা একটু জানা দরকার। আমাদের মানবদেহে অবিরাম নিঃশ্বাসের সঙ্গে ‘হং’ শব্দ এবং প্রশ্বাসের সময় ‘সঃ’ শব্দ উচ্চারিত হয়। একে বলা হয় ‘হংস’ মন্ত্র বা অজপা মন্ত্র। তন্ত্রমতে ‘হংস’ হলেন স্বয়ং ভগবতী, মহাশক্তি কুলকুণ্ডলিনী। এখানে শিব ও শক্তি অভিন্ন রুপে বিরাজমান।

চক্রাকারে আরাধনা
এই হংসেশ্বরী মন্দির খোলা থাকে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ও বিকেল ৪টে থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত এবং নিত্যপুজো হয় সকাল ১০টায়। এই মন্দিরে প্রতিদিন অন্নভোগ দেওয়া হয়, যার কুপন সংগ্রহ করতে সকাল ১০টার মধ্যে এবং ভোগ পরিবেশন করা হয় দুপুর সাড়ে ১২টায়। দেবীর বাৎসরিক পুজো হয় কার্ত্তিক অমাবাস্যায় দীপান্বিতা তিথিতে। এছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় ও স্নানযাত্রার দিন দেবীর বিশেষ পুজো হয়। ১৮২০ সাল নাগাদ দেবীর কিছু অলঙ্কার চুরি যায়। এর পরবর্তীকালে মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলে এলেও, মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখনও রাজবাড়ির সদস্যদের তত্ত্বাবধানেই রয়েছে।

পাশাপাশি হংসেশ্বরী এবং অনন্ত বাসুদেব মন্দির
এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে অনন্ত বাসুদেব মন্দির। তার ঠিক বিপরীত দিকে রয়েছে এখনো নৃসিংহদেব রায়ের রাজবাড়ি। এখানে এখনো এই পরিবারের সদস্যরা বসবাস করেন।

নৃসিংহদেব রায়ের রাজবাড়ি
হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রবেশপথের ঠিক আগেই বাঁ দিকে রয়েছে এই রাজবাড়ির প্রায় ধসে পড়া নহবতখানা।

ভগ্নপ্রায় নহবতখানা
হংসেশ্বরী মন্দিরের শিল্পকার্য অত্যন্ত নিপুণ, নিখুঁত ও মজবুত হওয়ার ফলেই তার স্থাপত্যে এখনো সেভাবে ফাটল ধরেনি। তবে এই বিরল স্থাপত্যকে এমতাবস্থায় টিঁকিয়ে রাখতে গেলে সরকার এবং রায় পরিবার দুপক্ষকেই সমান উদ্যোগ নিতে হবে।
রাজস্থানের বহু মন্দির বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলার মন্দিরের হালও খুবই খারাপ। তার মধ্যেই যে কয়েকটা মন্দির এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদেরকে স্বমহিমায় দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলে তবেই বাংলার হেরিটেজ বেঁচে থাকবে, অন্যথায় নয়।

নহবতখানার বর্তমান রুপ
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
· সরাসরি বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে নেমে হংসেশ্বরী মন্দির যেতে চাইলে হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকালে উঠতে হবে। বাঁশবেড়িয়া স্টেশন থেকে টোটোতে অথবা হেঁটেও পৌঁছে যাওয়া যায় হংসেশ্বরী মন্দির।
· এছাড়া হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল স্টেশন নেমে অটো অথবা বাসে হংসেশ্বরী মন্দির পৌছনো যায়। ফেরার সময়ও ওই একি ব্যাপার।
· বাঁশবেড়িয়ায় কার্ত্তিক পুজো খুবই বিখ্যাত। এই সময়ে ওখানে গেলে বিশেষ করে, কিছু পুরনো বারোয়ারী পুজো দেখতে অবশ্যই পরামর্শ দেব। সে গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।
· বাঁশবেড়িয়ায় বেশ কিছু পুরনো বনেদী বাড়ি রয়েছে। তাই শুধু মন্দির দর্শন করে চলে না এসে, আশেপাশের জায়গাগুলো একটু চোখ বুলিয়ে এলে মন্দ লাগবেনা আশা করি।

Comments