মজলিশে ঘেরা শহর মালদা
- Shrabanti Mitra
- Dec 10, 2020
- 10 min read
Updated: Dec 15, 2020

শীতকালের সময়টা আমার মোটামুটি বাঁধাধরা থাকে, কোন না কোন জেলার সফরের জন্য। যেহেতু আমি জেলাভিত্তিক বেড়ানো পছন্দ করি, তাই সারাবছর ধরেই মোটামুটি একটা ভাবনা-চিন্তা চলে যে কোন সময়ে কোন জেলায় যাওয়া যেতে পারে। গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে সপ্তাহান্তে, আমার কাছে দিন তিনেক সময় ছিল এবং এই তিনদিন সময়টা আদর্শ ছিল মালদা ভ্রমণের জন্য। তাই দেরী না করে হাওড়া থেকে দুপুরের ইন্টারসিটিতে উঠে পড়লাম মালদার উদ্দেশ্যে। আমি সাধারণত রাতের ট্রেনে যাওয়া পছন্দ করিনা, কারণ ট্রেনে আমার ঘুম হয়না। আর ঘুম না হলে পরেরদিনের সকাল থেকে, সারাদিনের টানটান ঘোরাঘুরি পুরো ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যায়। তাই ইন্টারসিটি স্লো ট্রেন হলেও মোটামুটি আমার ডিনার টাইমে নামিয়ে দিল, আর আমিও ট্রেন থেকে নেমে, একটা টোটো ধরে পৌঁছে গেলাম রথতলা মোড়ের কাছে হলিডে ইন হোটেলে। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে লম্বা একটা ঘুম। গাড়ির জন্য নিখিলদাকে আগে থেকেই বলা ছিল, তাই সকাল সকাল নিখিলদা সেই সরকারি আমলার গাড়ির মত দেখতে, সাদা অ্যাম্বাসাডরটা নিয়ে চলে এল হোটেলের সামনে। গাড়ি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর থেকেই চোখের সামনে গুপ্ত, পাল, সেন, বৌদ্ধ কিংবা মোঘলদের ইতিহাসকে একটু একটু করে দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম।

প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থানের বিষয়ে আলাদা আলাদা ভাবে লেখার আগে, তাই চট করে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক, “মালদা” বা “মালদহ” এর এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাসের দিকে।
‘মলদ’ নামে এক প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর নাম থেকে, ‘মালদহ’ বা ‘মালদা’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন। আবার অনেকের মতে, ফারসি ‘মাল’ যার অর্থ “ধনসম্পদ” ও বাংলা ‘দহ’ যার অর্থ “হ্রদ” বিশেষ এবং এই দুটি শব্দের সম্মিলিত রূপ হল “মালদহ”। “মালদা”-ই হোক, বা “মালদহ”, তা একসময় “পুন্ড্রবর্ধন” নামে পরিচিত ছিল। এই পুন্ড্রবর্ধন ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে। সপ্তম শতকে শশাঙ্ক পালের নেতৃত্বে, যখন গোটা অঞ্চলে পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এই “পুন্ড্রবর্ধন”, “গৌড়” হিসেবে পরিচিতি পায়। এই সময়ে এই সমস্ত অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এরপর, ১১০০ শতকের শেষের দিকে, সেনেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে পুরো অঞ্চলটিতে। লক্ষ্ণণ সেনের সময় আবার গৌড়ের নাম বদলে হয় “লক্ষ্ণণাবতী”। এর সাথে সাথে সেন সাম্রাজ্যে হিন্দুরা আবার আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ১২০০ শতকে লক্ষণ সেন যখন গৌড় এবং পান্ডুয়ার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন, সেইসময় থেকেই ধীরে ধীরে রাজকীয় গরিমা ক্ষয়ে যেতে থাকে এই অঞ্চলের। অবশেষে, ১২০৪ সালে মোঘল শাসক বখতিয়ার খলজী সেন সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে, বাংলার অধিকারপ্রাপ্ত হন। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে মুসলিম আগ্রাসনে ছেয়ে যায় গোটা মালদা।
একটা সময় এই জেলা রেশম চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। ফলে ইংরেজ সরকার রেশম ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য ১৭৭০ সালে গৌড় ও পান্ডুয়ার মাঝে, একটি ছোট্ট গ্রাম কিনে নেন এবং কোম্পানির উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় কুঠি। ইংরেজদের কুঠি বলে তখন এই স্থানটির নাম হয় “ইংরেজাবাদ”। এই ইংরেজাবাদের সঙ্গে আজকের মালদার জেলাসদর “ইংরেজবাজার” বা “ইংলিশবাজার” এর মিল আছে। তবে শুধু মধ্যযুগীয় ইতিহাসেই ঘেরা নয় মালদা শহর। এই শহরের বুকেই ঘটে গেছে সাঁওতাল বিদ্রোহের মত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।

মালদা মানেই আমাদের মনে একটা শব্দ আসে, যার নাম “আম”। তবে, শীতকালে বেড়াতে এসে আম না পেলেও আপত্তি নেই, কারণ সারাবছরই বাজারে ভরা রয়েছে “অথেনটিক আমসত্ব”। অথেনটিক কথাটা বললাম এই কারণেই, কারণ কলকাতার বাজারে যে সমস্ত আমসত্ব পাওয়া যায়, তার বেশীরভাগটাই কুমড়ো থেকে বানানো। অরিজিনাল আম থেকে বানানো আমসত্ব, এখন খুব কম জায়গাতেই পাওয়া যায়। মালদায় নেতাজী মোড়ের কাছে, চিত্তরঞ্জন মার্কেটে, রবিবার বাদ দিয়ে অন্য যে কোন দিন গেলেই আপনি একাধিক দোকানে পাবেন আমের বিভিন্ন ফ্লেভারের আমসত্ব। এছাড়াও রয়েছে খেজুর, আমপান্না, আমের আচার এবং বিভিন্ন রকমের ড্রাই ফ্রুট। একটু দেখে শুনে কিনলে দাম নিয়ে ঠকে যাবার সুযোগ নেই এখানে। আম ছাড়াও আর যে সেরা জিনিসটি পাওয়া যায় এখানে, তার নাম ক্ষীরদই। আপনি যে ব্যাপারটা ভাবছেন সেরকম একেবারেই নয় এটি। মাটির ছোট হাঁড়িতে রাখা জমাট ক্ষীরে আবৃত দই। নেতাজী মোড়েই ভালো মিষ্টির দোকান আছে। তবে, যেখান থেকেই নিন ৫০০ বা ১কেজির কমে নেবেন না। কারণ, এটি বাড়িতে ৫-৬ দিন রেখে খাওয়া যাবে আর মুখে দিলেই বুঝতে পারবেন “এ স্বাদের ভাগ হয়না।”
সবধর্মের মিলনক্ষেত্র, গোটা মালদা শহর, ঘিরে রয়েছে আদিনা, পান্ডুয়া ও গৌড়ের অসাধারণ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন। এবার একে একে আমার যাত্রাপথ অনুযায়ী সবকটি দর্শনীয় স্থানের ব্যাপারে, একটু একটু করে নজর দেওয়া যাক-
একলাখী সমাধিসৌধ

একলাখ টাকা! অঙ্কটা এখনো চমকে দেয় আমাদের। আর সে যুগের পান্ডুয়ার মানুষকে এতটাই আশ্চর্য করে তুলেছিল যে, যার থেকে নামকরণই করা হয় একলাখী সমাধি। জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহ নিজের মৃত্যুর আগেই নির্মাণ করেন এই সৌধটি। এখানে ওনার স্ত্রী ও পুত্রের সমাধিও রয়েছে। সৌধের বাহিরাংশে লিন্টেলের ওপর বেশ কিছু খোদাই করা স্থাপত্যচিহ্ন রয়েছে।
আদিনা বা জামি মসজিদ

সুবৃহৎ আদিনা মসজিদটি মালদা থেকে ১৫ কি.মি উত্তরে অবস্থিত। ভারতের অন্যতম বৃহত্তম এই মসজিদটি, আনুমানিক ১৩৬৩ সালে, সুলতান সিকেন্দার শাহ নির্মাণ করেন। শোনা যায়, অষ্টম শতকে দামাস্কাসে তৈরি হওয়া কোন এক মসজিদের আদলে এটি নির্মিত হয়। এই সুবিশাল মসজিদের প্রতিটি আলাদা আলাদা অংশ, আলাদা আলাদা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত। এখানে কোথাও রয়েছে মহিলাদের নামাজ পড়বার জায়গা, কোথাও রয়েছে অতিথিশালা। এই মসজিদের পাশেই রয়েছে সুলতান সিকান্দার শাহের সমাধি। গোটা মসজিদ জুড়ে ইঁটের অসামান্য কারুকার্য দেখতে দেখতে, চট করে মসজিদ প্রাঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে আসা মুশকিল হয়ে উঠবে যে কারোরই।

আদিনা মসজিদের আলোছায়ার খেলা
রামকেলি ধাম/ শ্যাম কুণ্ড

আগেই বলেছি মালদা সর্বধর্মসমন্বয়ে সমৃদ্ধ একটি জেলা। তাই আদিনা মসজিদ ছেড়ে বেরিয়ে আসবার পর গৌড়ে ঢোকবার মুখে রামকেলি মন্দির দেখে, একদম অবাক হবার কিচ্ছু নেই। মালদহ থেকে দক্ষিণের দিকে যেতে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি। প্রবেশের শুরুতেই রয়েছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর একটি মূর্তি। ১৫১৫ সালে বৃন্দাবন যাত্রার পথে এখানেই দুটি কেলিকদম্ব আর তমাল গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পদধূলি পড়েছিল তাঁর। এই দুটি গাছ এখনো আছে, আর তার তলাতেই পরবর্তীকালে স্থাপিত হয় প্রভুর পায়ের ছাপ রক্ষিত একটি মন্দির।

শ্রীচৈতন্যদেবের পায়ের ছাপ
মূল মন্দিরের ভিতরে রয়েছে পাঁচশো বছরের প্রাচীন বিগ্রহ এবং মন্দির সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে পাঁচশো বছর আগে রূপসনাতনের খনন করানো- আটটি বিশাল কুন্ড বা দীঘি।

মন্দিরের অভ্যন্তরে যিনি সদাজাগ্রত
বারোদোয়ারী বা বড়সোনা মসজিদ

মালদার অন্যতম সেরা আকর্ষণ বারোদুয়ারি বা বড়সোনা মসজিদ, যার নামে বারো শব্দটি থাকলেও, এখানে দুয়ার রয়েছে এগারোটি। গৌড়ের সবচেয়ে বড় মসজিদটি, সুলতান নূসরত শাহ ১৫২৬ সালে নির্মাণ করেন। গ্রীক ভাস্কর্যে ও আরবী সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এই বৃহৎ মসজিদটি সম্পূর্ণভাবে দেখতে গেলে হাতে বেশ খানিকক্ষণ সময় রাখতেই হবে।

বড়সোনা মসজিদের ভিতরপ্রাঙ্গনে ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়ে
দাখিল অথবা সেলামী দরওয়াজা

দৈর্ঘ্যে ৬০ ফুট এবং প্রস্থে ৭৩ ফুট, দরওয়াজাটি, পরিচিত ছিল গৌড়ের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবে। পাঁচতলা উচু এই ইমারতটি, ১৪২৫ সালে সুলতান বারবক শাহ নির্মাণ করেন। এই দাখিল দরওয়াজার গায়েও লাল ইট ও টেরাকোটার সুক্ষ কারুকার্য বিদ্যমান।

সেলামী দরওয়াজা
ফিরোজ মিনার

দিল্লীর কুতুব মিনারের আদলে তৈরি, তিয়াত্তরটি ধাপবিশিষ্ট, পাঁচ তলার এই সর্পিল সোপানাবলী সহ মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন সম্ভবত সইফুদ্দিন ফিরোজ। শোনা যায়, ইনি বরবক শাহকে হত্যা করে সুলতান হয়েছিলেন। মিনারটির চারপাশের টেরাকোটায় কারুকাজ থেকে তুঘলকি স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়।
গুমটি দরওয়াজা

এনামেলের টালি দিয়ে সাজানো, এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই তোরণটি ১৫১২ সালে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ নির্মাণ করেন। লোকমুখে শোনা যায়, সম্পূর্ণ নিখাদ সোনা দিয়ে তৈরি হয়েছিল গৌড় দুর্গের পূর্বদিকের এই প্রবেশপথটি।
চিকা বা চামকান মসজিদ

১৪৫০ সালে নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই স্থাপত্যটি আকার ও ব্যবহার উভয় বিষয়ের ক্ষেত্রেই বেশ বিতর্কিত। শোনা যায়, সম্রাট হুসেন শাহ এটিকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এই স্থাপত্যের অভ্যন্তরে, মসজিদকেন্দ্রীক আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের অভাবে, এটিকে মসজিদ বলে স্বীকৃতি দিতে চান না অনেকেই। আবার, এর ভিতরের দেওয়ালেও বেশ কিছু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে।মন্দিরটি নির্মাণেরসময়, হিন্দু মন্দির থেকে বিশেষ কারুকার্য করা পাথর আর মিনে করা ইট এনে ব্যবহার করা হয়, তাই এটির নাম চিকা বা চামকান মসজিদ রাখা হয়। আবার আরেকটি মত অনুসারে, একসময় এটির ভিতর বহু বাদুড় বা চামচিকারা বসবাস করত, ফলে এটির নাম “চিকা” মসজিদ রাখাহয়।
লুকোচুরি দরওয়াজা

গৌড়দুর্গের প্রবেশপথ হিসেবে তৈরি, এই দোতলা দরোয়াজাটি ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে শাহসুজা প্রতিষ্ঠা করেন। এর দুদিকে রয়েছে প্রহরীদের জন্য দুটি ঘর ও দোতলার ওপরে রয়েছে নহবতখানা।

লুকোচুরি দরওয়াজার অভ্যন্তরে
কদম রসূল মসজিদ

সেই সুদূর আরব থেকে পীরশাহ জালাল তাবরেজী, একটি মুল্যবান বস্তকে নিয়ে আসেন পান্ডুয়ার বড় দরগায়, আবার সেখান থেকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ সেটিকে নিয়ে আসেন গৌড় দুর্গে। তারপর তাঁর পুত্র সুলতান নসরত শাহ ১৫৩১ সালে সেটিকে কষ্ঠি পাথরের বেদির ওপর স্থাপন করে, তার ওপর কদম রসুল সৌধটি নির্মাণ করেন। সেই মুল্যবান বস্তটি হল, হজরত মহম্মদের পদচিহ্ন। এর সামনে রয়েছে বিরামশালার ধ্বংসাবশেষটি।
ফতে খাঁয়ের সমাধি

বাংলার দোচালা রীতিতে তৈরি, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি দিলওয়ার খাঁয়ের পুত্র ফতে খাঁর সমাধি এটি, যেটি আদতে একটি রাজনৈতিক রেষারেষির ফলপ্রসূ। ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭-এর কোন এক সময়ে, বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাহসুজাকে বিদ্রোহকরবার পরামর্শ দিয়েছিলেন পীর শাহ নিয়ামতুল্লা, তাই তাঁকে একপ্রকার জব্দ করতেই আওরঙ্গজেব পাঠান ওই দিলওয়ার খাঁকে। কিন্তু গৌড়ে পৌঁছবার পরই রক্তবমি করতে করতে মারা যান দিলওয়ারের পুত্র ফতে খাঁ। তাঁর সমাধির ওপর পরে নির্মাণ করা হয় এই স্থাপত্যটি।

রক্তাক্ত ইতিহাসের সমাধিস্থল
বাইশগজী প্রাচীর

চলতি রাস্তার একপাশেই একটি লম্বা আর উঁচু প্রাচীর, যার উচ্চতা ৬৬টি ফুট বা বাইশ গজ, তার থেকেই এর নাম রাখা হয় বাইশগজী প্রাচীর।বেশকিছু জায়গায় প্রাচীনত্বের সংস্কার হলেও, এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু কিছু অংশে এটির প্রাচীন ভগ্নপ্রায় রূপটি চোখে পড়ে।
বল্লালবাটী

বাংলার মাটিতে রাজত্ব করা সেন সাম্রাজ্যের একটি অন্যতম নিদর্শন বল্লাল বাটী। আগে যে জায়গায় একটি ঢিপি ছিল, সেখানেই ২০০৩ সালে খননকার্য চালিয়ে উদ্ধার করা হয়, প্রাসাদ বা কোন এক প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসবিশেষ। গোটা ধ্বংসাবশেষ জুড়েই রয়েছে অনেকগুলি গোলাকৃতি থামের আভাস এবং প্রতিটির মধ্যিখানে একটি করে গর্ত। অনেকেই মনে করেন এটি আদতে কোন রাজপ্রাসাদ নয়, বরং হতে পারে কোন বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ।

এই অঞ্চলেই ছিল একটি স্থানীয় বন্দর, গঙ্গা কাছাকাছি দুরত্বে হবার ফলে, এখানে এসে দাঁড়াতো বড় বড় নৌকো বা ছোট জাহাজ, তাই এই জায়গাটি জাহাজঘাটা নামে পরিচিত হয়। কালের ধারায়, গঙ্গাও সরে গেছে দূরে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হয়ে গেছে জাহাজঘাটার ইতিহাস।

কোতওয়ালী দরওয়াজা

সামনে লম্বা লাইন চেকপোস্টের। মাত্র কয়েক হাত দুরেই, পাশের দেশ বাংলাদেশ। সারি সারি লোক বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন এপার থেকে ওপারের দিকে, যাকে প্রাচীরের ওপর থেকে অনেকটা দেশভাগের মত দেখলে লাগে। কোতওয়ালী দরজা গৌড়দুর্গের দক্ষিণদিকের বহিঃপ্রাচীর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার একটি প্রাচীন নিদর্শন। প্রাচীন গৌড়ের উপনগরী থেকে মূল রাজধানীতে অনুপ্রবেশের একটিমাত্র মূল ফটক ছিল এটি, যার নামকরণ করা হয়েছে নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ ‘কোতওয়াল’ এর অনুকরণে। এখানে নগর পুলিশ(কোতওয়াল), গৌড় নগরীর দক্ষিণ দেওয়াল রক্ষা করার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যুকাল(১৩১৫) এবং গৌড়ে যে প্রাচীন শিলালিপি পাওয়া গেছে(১২৩৫), তার মধ্যবর্তী সময়ে দিল্লীর স্থাপত্যশিল্পের অনুকরণে নির্মিত এটি।

বাংলাদেশের পথ
লোটন মসজিদ

কোতোয়ালি দরওয়াজা থেকে ১কিমি উত্তরে অবস্থিত, লোটন মসজিদের ইতিহাস আজও জীবন্ত মনে হ্য়। এই মসজিদের বাহিরাংশের দেওয়ালটি এক সময়ে, ইঁটের উপর রঙিন মীনার কারুকার্যে পরিবৃত ছিল। এখনো এর অল্পবিস্তর অস্তিত্ব রয়েছে দেওয়ালের গায়ে গায়ে। সম্ভবত সুলতান ইউসুফ শাহ নির্মাণ করেন এই মসজিদটি।

লোটন মসজিদের অভ্যন্তরে
চামকাটি মসজিদ

চর্ম ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সংশ্রবে নির্মিত এই চামকাটি মসজিদ। বলা হয় সরু(চাম), রাস্তার(কাটি) ধারে এটির অবস্থান বলেই, এর নাম চামকাটি। আনুমানিক ১৪৭৫ সাল নাগাদ, সুলতান সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ নির্মাণ করেন এই মসজিদটি। তিন খিলানের, এই মসজিদের বিভিন্ন কোণে কোণে, খাঁজকাটা গোলাকার থামের কিছু ছাপ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। এই মসজিদের গঠনশৈলী অন্যান্য মসজিদের চেয়ে বেশ খানিকটা আলাদা, কারণ, এটির ভেঙে পড়া ছাদ, ওপরের গম্বুজটির পাঁচটি সূক্ষ ধাপ, দেওয়ালের মাঝে মাঝে রঙিন মীনের কাজ, মসজিদটিকে আলাদা ভাবে চিনতে সাহায্য করে।
গুনমন্ত মসজিদ

বেশ খানিকটা বনজঙ্গলের পথ বেয়ে, পৌঁছতে হয় এই সাম্রাজ্যে। ভাগীরথী নদীর তীরে মাহদিপুর গ্রামে অবস্থিত, গুণমন্ত মসজিদটিকে বাইরে থেকে, একটি সুবিশাল সাম্রাজ্যের মতই দেখতে লাগে। ২৪টি গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটি সুলতান জালালুদ্দিন শাহ নির্মাণ করেন। মসজিদের দুপাশে চারটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশপথ আছে। মসজিদের বিপরীত দিকের লম্বা প্রাচীরের স্থাপত্যের কাজ অসামান্য।

গুনমন্ত মসজিদের অভ্যন্তরে
মসজিদের মালদা সফর আপাতত এখানেই শেষ করে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারতে একটি কাছাকাছি দোকানে গেলাম। খাওয়াদাওয়া সারার পরই উল্টোদিকের রাস্তায় দেখি একটি মন্দির, সাইনবোর্ডে যার নাম লেখা হ্যাঁন্টাকালী মন্দির। নাম শুনে, বিশেষ কৌতূহলবশতই ঢুকে গেলাম মন্দিরের ভেতরে। গিয়ে দেখি আলাদা করে চমকিত হবার মত বিশেষ কিছু নেই। রয়েছে আর পাঁচটি মন্দিরের মতই কালীমায়ের একটি বিগ্রহ। মন্দিরের ইতিহাস কোথাও লেখা না থাকায় আর মন্দিরে কেউ না থাকায়, মন্দিরের বিষয়ে সেরকম কিছুই জানা যায়নি। শুধু বাইরের বোর্ড থেকে জানা গেছে, মন্দিরটি ১৯৪৭ সালে স্থাপন করা হয়েছিল।
এরপর হালকা জিরিয়ে নিতে এগিয়ে গেলাম মালদার উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত মহানন্দা নদীর ধারে।

মহানন্দা নদী
শান্ত নদী, নিঝুম দুপুর আর রোদ পড়ে যাওয়া উত্তুরে হিমেল হাওয়ায় আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছি, এরকম একটা সময়ে নিখিলদা তার রাজকীয় অ্যাম্বাসাডর থেকে বার দুয়েক হুংকার দিল। ব্যাস, ওমনি আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। কারণ, আমার সেদিনের শেষ গন্তব্যস্থলটি যাওয়া তখনো বাকী আছে।
জহুরা কালী মন্দির

দুপাশে বিস্তৃত মাঠ, বটগাছ আর ঘন আমবাগানের মধ্যিখানে, মালদা শহর থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, এই জহুরা কালী মন্দির। লোকমুখে কালী মন্দির বলা হলেও, এটি আসলে একটি চণ্ডী মন্দির। রাজা বল্লাল সেনের স্থাপিত, চারটি চন্ডী মন্দিরের মধ্যে অন্যতম। মন্দিরের গায়ে সাঁটানো বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায় ১০৮৩ বঙ্গাব্দে সাধক ছল্প তেওয়ারী সিদ্ধিলাভ দর্শনের মাধ্যমে, এখানে গড়ের ওপর জহুরা চন্ডী মাতার বেদী প্রতিষ্ঠা করে পুজোপাঠ শুরু করেন। এরপর ১২১৩ সালে কৌলিক সাধক হীরারাম তেওয়ারী দৈব দর্শন করেন এবং সেই অনুযায়ী মায়ের মূর্তির রূপরেখা তৈরি করেন কোন এক বৈশাখ মাসে। তাই প্রতিবছর বৈশাখ মাসে একমাস ব্যাপী কালীপুজো এবং মেলা হয় এই মন্দির সংলগ্ন এলাকা জুড়ে। এই মন্দির কোথাও আবার কালী না হয়েও কালী হয়ে উঠেছে, আরেকটি ভিন্ন মত অনুসারে। প্রাচীনকালে, একটি কালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ছিল এখানে, কিন্তু বিধর্মীদের থেকে রক্ষা করার জন্য মন্দিরের পূজারীরা মূর্তিটিকে মাটিতে চাপা দিয়ে দেন এবং সেই দেবীমূর্তির নীচে মাটিতে ডাকাতদল হীরে জহরত লুকিয়ে রাখত, ফলে সেই থেকেই এই মন্দিরের নাম, “জহুরাকালী” নামে খ্যাত।
গাঢ় ঘন লাল বিশাল এক ঢিবি আর তার ওপরে বসানো মায়ের মুখ, আদতে কল্পনায় ঘেরা এক মুখোশ –এটিই বর্তমান দেবীমূর্তির রূপ এখানে। মূল মুর্তির দুপাশে রয়েছে, আরো এমন কিছু মুখোশএবং গর্ভগৃহে রয়েছেন শিব ও গণেশের মূর্তি। শুধুমাত্র শনিবার এবং মঙ্গলবার খোলা থাকে এই মন্দির, আর এই দুইদিনই দিনের বেলায় মায়ের পুজো হয়।
ততক্ষণে সন্ধ্যের আলো জ্বলে উঠেছে চারিপাশে। ছোট ছোট গুমটির চায়ের দোকানগুলো ভরে উঠেছে জমায়াতে। সদ্য গজিয়ে ওঠা শপিং মলগুলোর আশেপাশে শুরু হয়ে গেছে লোকজনের আনাগোনা। ফাস্টফুডের দোকানগুলোও খুলে গেছে। ইংলিশবাজার পৌরসভার ঘড়ির স্তম্ভের লাল, নীল, সবুজ আলোগুলোও তাদের নিজেদের প্রাত্যহিক খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। আমিও আমার এই নতুন শহরটাকে দেখতে দেখতে, চিত্তরঞ্জন মার্কেট থেকে একটু আমসত্ব আর ক্ষীরদই নিয়ে বাসস্থানের দিকে এগোতে লাগলাম।
ফারাক্কা বাঁধ

পরেরদিন সক্কাল সক্কাল জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়েও রাস্তায় বিশাল ট্র্যাফিক জ্যাম, আর হট্টগোলের মুখোমুখি হলাম। সোমবার, হাটের দিন। গোটা রাস্তা জুড়ে কাপড়ের বিশাল লেনদেন চলছে। এসমস্ত কাটিয়ে ফারাক্কা পৌঁছতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। তবে ফারাক্কা আসলে, গেলেও হয়, না গেলেও হয়। কারণ, ফারাক্কা ব্রিজের ওপর গাড়ি খুবই ধীর গতিতে চালাতে হয়। গাড়ি থেকে নেমে জনসাধারণকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়না এবং সর্বোপরি, ছবি তোলা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ।
তবে আমি গেছিলাম, ওই আর কি, কিচ্ছুক্ষণ প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটানোর জন্য। তবে ফারাক্কা সংলগ্ন গান্ধীঘাটটি, প্রকৃতির মাঝে দুদণ্ড সময় কাটানোর জন্য বেশ মনোরম জায়গা।

গান্ধীঘাট
ঘুরতে ঘুরতে দূর থেকে বাঁধের কাজ দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম, এই সদা কর্মব্যস্ত ফারাক্কা বাঁধকে কেন্দ্র করে কত সংগ্রাম, কত লড়াই না হয়েছে। হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশন কোম্পানির নির্মিত এই বাঁধটি একচল্লিশ বছর আগে যখন গঙ্গার উপর দিয়ে চালু করা হয়, তখন তার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জলপ্রবাহের একটা অংশকে হুগলী নদীতে চালিত করে কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করা। তবে, সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল না-হলেও ফারাক্কার জেরে গঙ্গার উজানে যেভাবে পলি পড়া শুরু হয়েছে, তার ফলে, প্রতি বছরই বর্ষাকালে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ছে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একটা বিস্তীর্ণ অংশ।। তাই ফারাক্কা বাঁধ একটি আন্দোলনেরও নাম, যে সংগ্রাম মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী বিপর্যয়কবলিত মানুষেরা, আজও চালিয়ে যাচ্ছেন।

গান্ধীঘাট সংলগ্ন শ্মশানকালী মন্দির
কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে গেলাম গান্ধীঘাট সংলগ্ন শিবমন্দির ও শ্মশানকালী মন্দিরে। গঙ্গার পাড়ে গড়ে ওঠা এই মন্দিরগুলি নীল আকাশের নীচে দিনের আলোয়, বেশ উজ্জ্বল লাগছিল দেখতে।

শ্মশানকালী
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছিল, যে ট্রেনের আর বেশি দেরী নেই। তার আগে খাওয়াদাওয়াও সারতে হবে। তাই আর দেরী না করে উঠে পড়লাম গাড়িতে। ফারাক্কা সংলগ্ন এলাকায় ভালো বাঙালী হিন্দু খাবার দোকান পাবার ক্ষেত্রে একটু চাপ আছে। তবে রাস্তার দুধারে, একটু খোঁজাখুঁজি করলে মোটামুটি চালিয়ে নেবার মত খাবারের দোকান পাওয়া যাবে। খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে এগিয়ে চললাম ফারাক্কা স্টেশনের দিকে, ঘড়ির কাঁটা তখন ট্রেনের টাইমের প্রায় কাছাকাছি। আমার একটা স্বভাব আছে, লাস্ট মিনিটে গিয়ে ট্রেন ধরার, তাই এসব বিষয়ে আমি সেরকম একটা চাপ নিই না। তাই, ধীরে ধীরে ফারাক্কা স্টেশনের ঢালু পথ বেয়ে ওপরে উঠলাম। ট্রেন তখনও আসেনি...

আদিনা মসজিদের অভ্যন্তরে
এবার শেষবেলায় চট করে মালদা সফরকেন্দ্রীক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা সেরে নিই...
মালদা যাবার একগুচ্ছ ট্রেন আছে হাওড়া আর শিয়ালদহ থেকে। নিজের সুবিধে মত যে কোন ট্রেন বুক করে নিলেই হল।
থাকবার জন্য রথতলা মোড় বা ইংলিশবাজার এলাকা জুড়ে প্রচুর বাঙালী হোটেল রয়েছে বিভিন্ন বাজেটে।
ইংলিশবাজার এলাকায় থাকলে, লাইন দিয়ে পরপর খাবারের দোকান পাওয়া যাবে, এছাড়াও গোটা মালদাতেই খাবার-দাবার পাবার ক্ষেত্রে বিশেষ কোন অসুবিধা হবেনা।
ফেরার ক্ষেত্রে আমি পরদিন ফারাক্কা হয়ে ফিরেছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরে। এছাড়াও আরো কয়েকটি ট্রেন আছে, যেগুলি মালদা ও ফারাক্কা দুটি স্টেশনেই দাঁড়ায়।
মালদা চাইলে দিনের দিন ঘুরেও ফিরে আসা যায়(সেক্ষেত্রে আগের দিন রাতের ট্রেন ধরতে হবে), আবার পরের দিন ফারাক্কা বাঁধ ঘুরেও দুপুরের ট্রেনে ফেরা যায়।
গাড়ি যদি আগে থেকে বুক করা নাও থাকে, তাহলেও খুব একটা অসুবিধে হবেনা। কারণ প্রচুর গাড়ি স্ট্যান্ডে দিনের দিন ভাড়া পাওয়া যায়। তবে বেসিক গাড়ি বলতে এখানে একটাই অ্যাম্বাসাডর, যার একদিনের আদিনা, পান্ডুয়া ও গৌড়ের ভাড়া ১৩০০-১৪০০ টাকা। পরের দিন ফারাক্কা গেলে আলাদা ভাড়া। তবে, এর চেয়ে আর একটু বেশী টাকাপয়সা খরচ করলে আরও ভালো গাড়ি পাওয়া যায়।
অতএব, আগামী শীতের উইকেন্ড হেরিটেজ ট্যুরের তালিকায়, ছোট্ট দেড় দিনের এই মালদা সফরকে মাথায় রাখা যেতেই পারে।

Comments