রেড রোড আর প্রজাতন্ত্র
- Shrabanti Mitra
- Jan 26, 2021
- 2 min read
Updated: Jan 27, 2021

বর্ষশুরুর প্রথম সরকারী ছুটির দিন, যার নাম ২৬শে জানুয়ারী। মা তুঝে সালাম, চক দে ইন্ডিয়া থেকে পাড়ার মোড় অবধি পতাকা নিয়ে সারি বেঁধে হেঁটে যাওয়ার পর ডিম-পাউরুটি। তারপর বেলা গড়ালে মাংস-ভাত, দুপুরে একটা টানটান ঘুম, বিকেলে পাড়ার মঞ্চের জাতীয় ভাষণের অমাইক শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়া- এভাবেই তো কেটে যায় বছরের পর বছর ধরে একটি আদর্শ দেশমাতৃকাবোধে জর্জরিত গণতান্ত্রিক দিন।

আমি প্রজাতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র, গণতন্ত্র কিছুই তেমন বুঝি না। পথে পথে, চলতে ফিরতে শুধু দেখি মানুষগুলো একে ওপরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর দেশের মানচিত্র জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

ভাগ...শুধু ভাগ। জন্মের পর থেকে শুধু শুনে গেলাম, দেখে গেলাম ভাগ হয়ে গেছে, ভাগাভাগি হচ্ছে, ভাগ হয়ে যাবে, ভেঙে যাবে, থাকবে না ইত্যাদি সব শব্দ। তবে, ওলিতে-গলিতে হিংসা দেখেছি যত, ভাগাভাগি করে ভালোবাসাও কিছু কম দেখিনি।

এসব নিয়েই কি আমার দেশ? যেখানে সবাই মোটামুটিভাবে, পাশাপাশি বসবাসকরা সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দিনযাপ্ নিজেদের ভেতরে অজান্তেই জড়িয়ে ফেলেছ। কাছাকাছি থাকা ভিন্নভাষী মানুষজনের বাকচারিতার ভঙ্গিটা, সানন্দে চালিয়ে নেবার মত করে আউড়ে গেছে অনর্গল। এ দেশের সব ভাষা, সব জাতি রক্তস্রোতে গা ভাসাবার পরেও মিশে যেতে পারে গণতন্ত্রের মোহনায়।

সেবার রেড রোডে এমনি একটা মিশ্র অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছিলাম।

পারস্পরিক বন্ধুত্বের দুই ভিন্ন রুপ

এ ছবি সকলের চেনা, এ গল্প সকলের জানা, গালে তেরঙা স্টিকার, মাথায় স্বাধীনতার তেরঙা রিং, চুলের রঙিন বাহার, কেক, প্যাটিস, বেলুন আর সারি সারি মানুষের ভিড় সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখবার আকাঙ্ক্ষায়।

এর আগে আমি কখনো ক্যামেরা হাতে রেড রোডে যাইনি। তাই সশস্ত্র বাহিনীর রঙিন দলগুলো একের পর এক আমায় অভিভূত করেছিল সেদিন পরতে পরতে।

নবভূষণে ভূষিত যুদ্ধের ট্যাঙ্কগুলো যখন যে যার গৌরবরক্ষায় ব্যস্ত, আমি তখন যুবসেনাদের পায়ের ছন্দের দৃঢ়তায় বিস্মিত হচ্ছিলাম, শক্তি পাচ্ছিলাম ভেতরে ভেতরে।

ব্যাস্ততা যখন তুঙ্গে

এমন সময় এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মত ফুল্লকুসুমিত তান্ডব আমার স্বচ্ছ পরিবেশটাকে নিমেষে ধূলিধূসরিত করে তুলল। আমি তখন হাঁকুপাঁকু করে চশমা, চোখ, ক্যামেরার লেন্স ইত্যাদি বাঁচাতে ব্যস্ত। খানিক পরে, একটু সামাল দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি কিছু গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে পথের মাঝে। কী নিষ্ঠুর এ বিস্ময়! ভাঙা পথের রাঙা ধূলায় আভিজাত্য লুটায়ে যায়।

সত্যি রাজনীতির এ চোখ ধাঁধানো খেলায় কত ফুল ঝরিয়া যায়, যানতি পারা যায়না।

এসব ঝড়বাদল পেরিয়ে প্রাথমিক অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণার পর এগিয়ে চললাম ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে। সেখানে তখন সতর্ক প্রহরী। লাল সাইরেন বাজিয়ে দামী দামী গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ রাজবেশে পথে নেমে, যাত্রাপথ প্রদক্ষিণ করতে করতে জনসাধারণের উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়ে ফের গাড়িতে উঠে পড়লেন। এই ব্যাপারটা আরো দু-চার রাউন্ড ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হবার পর রাস্তাটা যখন এক্কেবারে ফাঁকা হয়ে গেছিল, তখন শহরটাকে বড় প্রাচীন মনে হয়েছিল সেদিন।

ফোর্ট উইলিয়াম,কলকাতা

একদিকে সাহেবী আমলের ফোর্ট উইলিয়াম, অন্যদিকে গঙ্গা, অপরদিকটা ফাঁকা গড়ের মাঠ, আরেকদিকে ডালহৌসির বড় বড় বাড়িগুলো।

বল বীর, বল উন্নত মম শির
প্রজাতন্ত্রের আক্ষরিক রূপগুলো সব জ্বলজ্বলে চেহারায় ইতিহাস আগলে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে। তাদেরকে বইয়ের পাতা ছেড়ে আরও কয়েকবার সামনে দেখতে দেখতেই সার্বভৌমত্বের যাবতীয় ভারী বিশেষণ স্থির চোখে নির্বাক হয়ে যায়।

আরেকটা বছর ঘুরে যায়, পৃথিবীর অগ্নিদগ্ধা রূপ ক্রমশ গাঢ় ভস্মে পরিণত হয় হানাহানির আঁচে পুড়তে পুড়তে। রাজনীতি, গণতন্ত্রের গৌরবরক্ষার প্রতিযোগিতায় অর্থব্যয় বাড়াতে থাকে, ধাপে ধাপে একটু একটু করে।

প্রজাতান্ত্রিক মুহূর্তেরা

এসব ভাবতে ভাবতে তখন প্রায় ধর্মতলার কাছে চলে এসেছি। ছুটির দিন। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। একটা ছোট পতাকা মাঝরাস্তায় পড়েছিল, কেউ হয়ত রেড রোডের পদযাত্রার শেষে ফেলে দিয়ে গেছে। দুটো অর্ধনগ্ন কিশোর প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে তুলে নিয়ে, কাড়াকাড়ি করে হাত ঘুরিয়ে ওড়াতে ওড়াতে, দে দৌড়!

ঘোড়াবাহী সৈন্যরা
সে উচ্ছাস ক্যামেরাবন্দী করে রাখবার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম ওদের দিকে, আর মনে মনে গুনগুন করছিলাম, “পুড়ে যাক হতাশা, স্বাধীনতায়”...।।

コメント