top of page

রাবড়ির উৎস সন্ধানে

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Nov 8, 2020
  • 5 min read

ree

“রাবড়িগ্রাম? রাবড়ির আবার গ্রাম হয় নাকি?”- মা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, “হ্যাঁ, হয়। অনেকে গেছে। রাবড়ি খেয়েছে। এবার আমিও যাব।” মা বলল, “তা ক’কেজি বাড়ির জন্য আনবি?”, আমি বললাম, “যত কেজি ব্যাগে ধরবে”। মা বলল, “আচ্ছা, যা”। ব্যাস, প্রাথমিক কর্তব্য সেরে ওঠার পরেরদিনই সক্কাল সক্কাল দাম্বা একখানা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে মেট্রো ধরে দমদম, তারপর ট্রেন ধরে ডানকুনি, তারপর ব্রিজ টপকে দেখি ২৬সি বাস দাঁড়িয়ে। বাসে ওঠার পরবর্তী এক ঘণ্টা আপনাকে কাশির সিরাপের ব্যাবহারিক কর্তব্যের কথা মনে করাতে করাতে এগিয়ে নিয়ে যাবে। একটা সময়ের পর বাস গড়ের মাঠ হয়ে উঠলেও আপনার আর একটুও বসতে ইচ্ছে করবেনা। কিন্তু না, আপনাকে স্টেডি থাকতে হবে, কারণ আপনার ব্যাগে ক্যামেরা আছে।মাঝে মাঝে অবশ্য মনটা, “আঁইয়া!,আঁইয়া!” বলে চিৎকার করতে চাইবে,তবে পাক্কা এক ঘণ্টার আগে এ যাত্রায় মুক্তি নেই...তাই, লড়ে যেতে হবে। অবশেষে, যখন আঁইয়া পাঁচমাথা মোড়ে নামবেন, তখন আপনার মনে হবে, যাক, হাড়গোড়গুলো নিশ্চয়ই ঠিকঠাকই আছে।


ree

গাংপুর আঁইয়া পাঁচমাথা মোড়


একটু হেঁটে দেখি তো... এই বলে, আপনি “আচ্ছা দাদা, রাবড়িগ্রামটা কোনদিকে?” দাদা, “ওই তো সোজা গিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে ঢুকে যান”, শুনে নিয়ে টুকটুক করে হাঁটা শুরু করবেন। হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে পৌঁছে যাবেন হুগলী জেলার চন্ডীতলা ব্লকের গ্রাম, যার গ্রামীণ নাম গাংপুর, আর শহুরে নাম রাবড়িগ্রাম। ঠিক যেমন করে আমি পৌঁছেছিলাম।


ree

অপেক্ষার অবসান


ঢুকতেই এক মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি গো? রাবড়ি নেবে নাকি?” আমি বললাম, “ঘুরে দেখছি”। উনি বললেন, “যাও,যাও, ঘোরো। এ পাড়ায় সব বাড়িতেই রাবড়ি হয়।”


ree

জোর কদমে চলছে রাবড়ি প্রস্তুতি


হ্যাঁ, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা- এ গ্রামে রাবড়িই ভরসা। দুধ আসতে এখন প্রায় বেলা ১২টা বেজে যায়। দুধ আসার মিনিট দশেকের মধ্যেই বসে পড়তে হয় কাজে। প্রথমে মাটির উনুনে ঘুঁটে সাজিয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তারপর ৫ কেজি কয়লা দেওয়া হয় কম করে, যাতে আঁচ ওঠে ভালো করে। আঁচ উঠে যাবার পর, চারধারে ইঁট সাজিয়ে, ভালো করে কড়াই মুছে, দুধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। দুধ ভালো করে ফুটে যাবার পর, খুন্তি দিয়ে ফেনাটাকে তুলে দিতে হয়। তারপর কাঠি দিয়ে দুধটাকে নাড়ানোর পাশাপাশি, পাখা দিয়ে হাওয়া করে যেতে হয়। একটু করে সর পরার সাথে সাথেই, কাঠি দিয়ে সেগুলোকে তুলে কড়াইয়ের ধারে ধারে লাগিয়ে দিতে হয়। যতক্ষণ না পুরোপুরি সর তৈরি হচ্ছে, ততক্ষণ, কড়াই ছেড়ে উঠতে পারেনা কেউ।


ree

দুধ ঘন হয়ে ওঠার সাথে সাথে কাঠি দিয়ে সর তোলা চলছে


মোটামুটিভাবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে পুরপুরি সর তৈরি হতে। এরপর চিনি দেবার পালা। সাধারণত, এই সমস্ত ঘরে তৈরি রাবড়ি যেহেতু, বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে সাপ্লাই দেওয়া হয়, তাই দোকান থেকে চিনির পরিমাণ কিরকম চাইছে, তার ওপর নির্ভর করে দেওয়া হয়। চিনি গলে যাবার পর, খানিকটা ক্ষীর দিয়ে নামিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ঠাণ্ডা হলে হাতা দিয়ে ফেটিয়ে নেবার পর, ছুরি দিয়ে পিস করে কেটে আলাদা আলাদা ক্যানের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়।


ree

নামিয়ে নেবার পর জমাট বাঁধনে তৈরি রাবড়ি, শুধু ঠাণ্ডা হবার অপেক্ষা


এখানে, গোটা গ্রামে মূলত, দু-ধরণের কোয়ালিটির রাবড়ি পাওয়া যায়। একটি হালকা মিষ্টি যুক্ত রাবড়ি, যার দাম ৩০০-৩৫০ টাকা কেজি প্রতি, আর একটি একটু বেশী মিষ্টি যুক্ত রাবড়ি, যার দাম ২৫০-৩০০ টাকা কেজি প্রতি। আমার অবশ্য, বেশী মিষ্টির রাবড়িটাও, খুব বেশী মিষ্টি বলে মনে হয়নি। দুটোই চাইলে কেনা যেতে পারে। প্রতিদিন প্রায় ৬-৭ কেজি রাবড়ি তৈরি হয় প্রতিটি ঘরে।


ree

দুধ পৌঁছে দেওয়া হয় এভাবেই ঘরে ঘরে


দুধ, আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে গোয়ালারা এসে দিয়ে যায়। প্রতিদিন অর্ডার অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ দুধ নেওয়া হয় দুধ বিক্রেতাদের কাছ থেকে। যে দিন যতটা পরিমাণ অর্ডার আসে, সেইদিন কমবেশি সেই পরিমাণই রাবড়ি বানানো হয় ঘরে ঘরে।শীতকালে, চিনির পাশাপাশি খেজুরের গুড় দিয়েও রাবড়ি বানানো হয়, যার দাম থাকে প্রায় একই। প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে এই কাজ চলে আসছে গাংপুরের ঘরে ঘরে।

ree

রাবড়ি প্রস্তুতিতে মগ্ন রাসমণি হালদার


ঘুরতে ঘুরতে চলে গেছিলাম জিতেন হালদারের বাড়ি, এই গ্রামের রাবড়ি তৈরির শুরুর দিকের গল্পের কথা জানতে। বাড়িতে তখন জিতেন হালদারের স্ত্রী রাসমণি হালদার, কাঠি দিয়ে দুধের সরগুলো আলাদা করছেন এক হাতে, আর অন্য হাতে ক্রমাগত হাত পাখা দিয়ে হাওয়া করে যাচ্ছেন। কাজ করতে করতেই আমাকে বললেন, ২০ বছর ধরে ওনারা রাবড়ি বানিয়ে আসছেন। একদম শুরুতে পান্না বালতি নামের এক মহিলা, মিষ্টির দোকানে কাজ করতে করতে নিজের বাড়িতে রাবড়ি তৈরি করা শুরু করেন। এরপর একে একে, মনসা বালতি, দুলাল বালতিরাও হাত লাগান এই কাজে।(“আচ্ছা, বালতি কি তোমাদের সবার পদবী?”,আমি বেমক্কার মত মাঝখানে প্রশ্নটা করে ফেলেছিলাম,যদিও সন্তোষজনক উত্তর তেমন কিছুই পাইনি।) শুরু হয়, রাবড়ি বানানোকে কেন্দ্র করে এক নতুন রুটিরুজির ঠিকানা। ধীরে ধীরে গোটা গ্রামের মানুষ নিযুক্ত হন এই কাজে, গাংপুর ক্রমেই লোকের মুখে মুখে পরিচিত হতে থাকে, রাবড়ি গ্রাম হিসেবে।


ree

এমনই তিন থেকে চার কড়াই রাবড়ি পরপর বানানো হয় এক একদিনে


গত দু'এক বছরে এই রাবড়িগ্রামের প্রচার আগের থেকে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। কলকাতা এবং শহরাঞ্চলের নামী দামি মিষ্টির দোকানের রাবড়ির উৎসস্থল যে রাবড়িগ্রাম, তা লোকের মুখে মুখে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার পাবলিসিটিতে অনেকখানি প্রচারের আওতায় এসেছে। তার ফলে, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের মধ্যে গ্রাম থেকে সরাসরি রাবড়ি কেনবার চলও তৈরি হয়েছে। মোটামুটিভাবে, ২৫০-৩০০ টাকা কেজি দরে, ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি হিসেবে রাবড়ি বিক্রি হয় এখানে। প্রতিটি বাড়িতেই নমুনা স্বরূপ অল্প পরিমাণে খানিকটা রাবড়ি প্রত্যেককেই দেওয়া হয়। হ্যাঁ, সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই। এরকম করে করে সারাদিন যে কত কত নমুনা স্বরূপ অল্প পরিমাণে রাবড়ি পেটে গেছে, যার ফলে সারদিন আর পেটে দানাপানি দিতে হয়নি, সন্ধ্যের দিকে ভেতরে একটা হালকা গুরগুর ভাব হচ্ছিল বটে, তবে ওসব এক আধদিন হতেই পারে, রাবড়ি বলে কতা!


ree

সদ্য বানানো রাবড়ি


যাইহোক, যা বলছিলাম। আজকাল ব্যবসার হার কিংবা লাভের পরিমাণ ঘরে ঘরে আগের চেয়ে বেশ খানিকটা বেড়ে গেলেও, মিষ্টির দোকানদারদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হবারও বেশ একটা বড় দিক রয়েছে এর। কারণ, এঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দোকানদাররা জানতে পারেন,যে এনারা আলাদা ভাবে রাবড়ি বিক্রি করছেন বানানো দামে, যেখানে দোকানের দাম কেজি প্রতি ৪০০-৪৫০ টাকা, তার ফলে এনাদের সাথে তারা আর ব্যবসা করতে চাইবেন না, এবং গোটা গ্রামের মানুষের রুটিরুজি এভাবেই নষ্ট হবে। তাই তাঁরা একদিকে যেমন আনন্দিত, তেমনই অন্যদিকে চিন্তিত। তাই কোন কোন মিষ্টির দোকানে এঁদের বানানো রাবড়ি সাপ্লাই দেওয়া হয়, তার ব্যাপারে কেউই খুব একটা মুখ খুলতে চান না।


ree

দুধের গন্ধে ম' ম 'করে গোটা গ্রাম


তবে গ্রামের সকলে যে তাদের কাজের প্রচার চায়, তা বলা যায়না। কারণ, বেশ কয়েকটি বাড়িতে বাইরে থে্কে আসা মানুষের অনুপ্রবেশ কিংবা ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া হয়না। কেউ কেউ আবার তখনই বাড়ির ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেবেন বলেন, যখন তাঁদের থেকে রাবড়ি কিনে নিয়ে যাওয়া হবে।


ree

মনসা বালতির বাড়িতে রাবড়ি বানানো চলছে


সেই শুরুর সময় থেকে এখনো অবধি মনসা বালতির পরবর্তী প্রজন্মের মানুষেরা রাবড়ি বানিয়ে চলেছেন প্রতিদিন। তাদের অবশ্য প্রচারে বিমুখতা নেই একেবারেই। নিজেদের রাবড়ি বানাবার গল্প সকলের সাথে ভাগ করে নিতে উৎসাহী সর্বদাই। প্রতিদিন, দু থেকে তিন কড়াই রাবড়ি বানানো হয় এই বাড়িতে, কোনো কোনো বাড়িতে আরেকটু বেশী। সব কাজ শেষ করে উঠতে উঠতে প্রায় বেজে যায় বিকেল পাঁচটা। এর ফাঁকে ফাঁকেই চলে সারাদিনের রান্না।


ree

গাংপুর- আমাদের রাবড়িগ্রাম


তখন বিকেল গড়িয়ে এসেছে গাংপুরের মাঠে। ফসল তোলার কাজ সেরে ঘরে ফিরছেন পুরুষেরা। মাটির দাওয়া, উনুন মুছে পরিষ্কার করে থরে থরে, পরপর ক্যানগুলোয় সদ্য বানানো রাবড়ি ভরে ভরে, ঢাকনা দিয়ে রাখছেন মহিলারা। আমিও ক্রমে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে কয়েক কেজি রাবড়ি, একের পর এক ব্যাগে ভরতে ভরতে এগিয়ে চললাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আগামী কয়েকদিন মুখরোচক চানাচুরের বদলে রাবড়ি খাব, ওঠা বসার ফাঁকে ফাঁকে।

ree

 
 
 

Comments


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page