top of page

রায়পুর রাজবাড়ি

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Apr 26, 2021
  • 4 min read

Updated: Apr 27, 2021


ree

পোড়ো রাজবাড়ি বলতে ঠিক কি বোঝায়? ভাঙ্গা পাঁচিল, ইঁট বেরিয়ে পড়া দেওয়াল, খাঁজে খাঁজে গজিয়ে ওঠা আগাছা, চামচিকের ডাক, ঝুলন্ত সিলিং, উড়ে যাওয়া পায়রার শব্দ, কোনের দিকটায় জঙ্গলের আনাচে-কানাচে সাপখোপের বাসা ইত্যাদি...ইত্যাদি...ইত্যাদি...এ লিস্টি শেষ হবেনা।

আসলে, ছবিটা এখনো বেশ স্পষ্ট মনে। শান্তিনিকেতনের খুব কাছে, সরু লাল মাটির রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়ে যে এরকম একটা প্রাচীন ধ্বংস হতে যাওয়া অট্টালিকা স্বচক্ষে দেখা যেতে পারে, ব্যাপারটা ভেবেই আমার বেশ অবাক লেগেছিল সেদিন।


ree

রায়পুর রাজবাড়ি


প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন, তিনমহলা একটা ভগ্নপ্রায় প্রাসাদ। বর্তমানে যার একটি মহলও সম্পূর্ণরূপে আস্ত নেই। সেদিন পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেছিল। বিকেলের হলুদ আলো কার্নিশ বেয়ে ঢুকে পড়েছিল, ভাঙ্গা বাড়ির আড়ালে আবডালে। বাড়ির পেছনের দিক থেকে ভেতরে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত গা ছমছম করা রোমাঞ্চকর পরিবেশের আভাস পাওয়া গেল। তারপর থেকে যেদিকেই যাবার চেষ্টা করছি, সেদিকেই দেখছি শুধু ভাঙ্গা দেওয়াল, ওপরে তাকালে ছাদের বদলে দেখতে পাচ্ছি চৌকো একটা নীল আকাশ।

ree

দু-একটা জায়গায় থামের ওপর অল্পবিস্তর স্থাপত্যের কারুকাজ অবশিষ্ট থাকলেও, ভিতরের বিশেষ বিশেষ অংশে সুক্ষ কারুকাজগুলো একেবারেই নিশ্চিহ্ন। ভেতরে একটা কুয়ো রয়েছে এখনো। গোটা বাড়িটায় জানলা-দরজা বলতে কিছুই নেই, উপর নীচে মিলিয়ে সবকটা প্রবেশদ্বারই হাঁ করা প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকে দিবারাত্র।

ree

বাড়ির কোণের দিকে দেওয়ালের পিছন দিকটায়, যেখানটা এখন সবুজ জঙ্গলপ্রায়, আগে সম্ভবত ছোট ছোট সিঁড়ি দিয়ে নেমে বারান্দার অংশে প্রবেশ করতে হত সেখানে।

ree

যা কিছু আজ পরিত্যক্ত


বাড়িটাকে এক ঝলক দেখলে হয়ত মনে হতে পারে একটা পরিত্যক্ত বাগান, যেটাকে পেরোতে পারলে, মস্ত একটা প্রাসাদে প্রবেশ করা যেতে পারে। ভিতরের প্রায় সবকটা দেওয়াল জুড়েই ভালবাসার নামগুলো খোদাই করা রয়েছে, বাকি সব জায়গার মত এখানেও। এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, ভাঙ্গা কাচের বোতল, বিড়ি সিগারেটের প্যাকেট। ছোট ছোট উদাহরণগুলো আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাতের অন্ধকারে এখানে গোপন আড্ডার ঠেক চলে প্রায়শই।


ree

ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে জানা গেল, এই রায়পুর রাজবাড়ি গড়ে ওঠার পিছনে দুটি ভিন্ন মত রয়েছে। আর এই দুটি ভিন্ন মত সৃষ্টিতে দুটি ভিন্ন পরিবারের অবদানের রয়েছে সমগ্র রায়পুর জুড়ে।


ree

রাজবাড়ির সামনের অংশ


প্রথম মতানুসারে, বোলপুরের অজয় নদের তীরে আদমপুর নামক একটি অঞ্চলে স্থানীয় লোকজন আগে বসবাস করত। অজয় নদে বন্যার ফলে স্থানীয় লোকজনের সাথে সাথে রায়চৌধুরীরাও উত্তরের দিকের জমিতে(বর্তমানের রায়পুর) উঠে এসে নতুন করে বসতি স্থাপন করতে আরম্ভ করে। এরপর ধীরে ধীরে জমিদারি বিস্তৃত হতে থাকে রায়চৌধুরীদের। ভারতের বর্গী আক্রমনের সময় সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে, বর্গী হামলাকে দক্ষতার সাথে প্রতিহত করেন, তৎকালীন জমিদার জিতানাথ দত্তচৌধুরী। এই খুশীতে সম্রাট আলিবর্দী খাঁ তাঁকে ‘রায়চৌধুরী’ উপাধি দেন এবং সঙ্গে পুরস্কার বাবদ দেন এক হাজার টাকা ও বাড়ির গোপীনাথ ঠাকুরের নামে এক হাজার বিঘা জমি। এই রায়চৌধুরীরাই পরবর্তীকালে রায়পুর রাজবাড়ি তৈরি করে বসবাস করা শুরু করেন।


ree

ইটের ঘাঁজে আগাছার জঙ্গল


দ্বিতীয় মতানুসারে, ১৭৬৪ সালে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা থেকে সিংহ পরিবারের আদিপুরুষ লালচাঁদ দে অজয় নদের তীরে, এই ছোট্ট গ্রাম রায়পুরে চলে আসেন। এখানে আসবার পর স্বচেষ্টায় ব্যবসা দাঁড় করাবার উদ্যোগ নিয়ে, তিনি প্রায় এক হাজার তন্তুবায়কে নিয়ে এসে কাজে যুক্ত করেন। ১৭৭০ সালে চৌধুরীদের থেকে জমিদারি কিনে আসতে আসতে এই গ্রামের স্থানীয় জমিদার রূপে পরিগনিত হন লালচাঁদ। এর পরবর্তীকালে এই পরিবারের আরেক রাশভারী ব্যক্তি বিশ্বম্ভর সিংহ বর্ধমানের রাজার থেকে ‘রায়’ খেতাব পান এবং বলা হয় সেখান থেকেই আদমপুর পরবর্তীকালে ‘রায়পুর’ বা ‘রাইপুর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর সিনহারাই এই অঞ্চলে রায়পুর জমিদারবাড়ি গড়ে তোলেন।


ree

এই পরিবারের সবচেয়ে স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন স্যার সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। বাড়িতে না জানিয়ে দুই ভাই মিলে চুপিচুপি বিলেত যাত্রা করার পর, ১৮৮৬ সালে ‘লিঙ্কনস ইন’ থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরপর ১৯১৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে, সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন এবং ১৯১৯ সালে ব্রিটেনের সংসদ, হাউস অব লর্ডসের ভারতীয় সদস্য হন। এরপর ১৯২০ সালে বিহার-উড়িষ্যার গভর্নর পদে নিযুক্ত হলে, তৎকালীন সরকার বাহাদুরের তরফ থেকে তাঁকে ‘নাইট’ উপাধিও দেওয়া হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ পরিচিত হন লর্ড সিনহা নামে এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায়পুরের “রাজা” হিসেবে ঘোষণা করেন।


কলকাতায় শেক্সপিয়ার সরণী আর এলগিন রোড ঘেঁষা এখনো একটা রাস্তার নাম “লর্ড সিনহা রোড” নামেই পরিচিত।

ree

গৃহদেবতা নারায়ণের মন্দির

ree

রাজবাড়ির সামনে লাগোয়া মন্দিরে রয়েছেন কুলদেবতা নারায়ণ। মন্দিরের সামনে চওড়া চাতাল ও উল্টোদিকে নহবতখানাও রয়েছে। এখনো প্রতিদিন দু’বেলা নিত্যসেবা হয়ে থাকে এখানে।


ree

নহবতখানা

ree

কুলদেবতা নারায়ণ


ক্রমে বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। একটা হালকা নীল আলো ছড়িয়ে পড়েছে রাজবাড়ির সর্বত্র জুড়ে। ডানদিকের দেওয়াল ধরে হাঁটছি, হঠাৎ চি চি শব্দ করে দুটো চামচিকে উড়ে গেল পাশ দিয়ে। ঝি ঝি পোকা ডাকতে শুরু করেছে জঙ্গলের আনাচকানাচ থেকে।


ree

দোতলার পিলারগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল, এই বাড়িটার কোন একটা ঘরে হয়ত জলসা হত এককালে। যেন দেওয়ালে কান পাতলে এখনো সেসব উচ্ছল মুহূর্তের ইতিহাস, ফিসফিসিয়ে কথা বলবে কখনো-সখনো।

ree

সন্ধে-রাত্তিরের দিকটায় বাড়ির কোন অংশের চাঙর খসে পড়বার তীব্র আর্তনাদে আর আমগাছের দুলুনিতে কখনো-সখনো অতৃপ্ত অশরীরীর ঠাণ্ডা বাতাস খেলা করে যায় হয়ত।

ree

সেপিয়া মোডের চুন সুরকীর আড়ালে কত কথাই তো জমে আছে, রাতের অন্ধকারে সেসব কথা ভাসতে থাকে রোজ তিনমহলা জুড়ে। এই বাড়িতে রাত কাটানোর সুযোগ পেলেও, সে অভিজ্ঞতা বলবার সুযোগ আর পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে হলপ করে বলা যাচ্ছেনা তেমন।


ree

বাইরে বেরিয়ে দেখি চারপাশটা গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে এসেছে। সেই ঘনীভূত অন্ধকারের মাঝেই একটা হলদেটে আভা, ভরিয়ে তুলেছে পশ্চিমের আকাশটাকে। শুধু চাঁদের আলোয় যতটুকু আলোকিত, ততটুকু দেখে দেখে সতর্কিতে পথ পেরোচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে মনে হল, এদিকেই কোথাও যেন, নির্জন ছায়াপথে মেশা লাল মাটির আশপাশ দিয়ে, গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে বেয়ারারা এগিয়ে গেছে পালকি নিয়ে। বাবুদের বাড়ি থেকে দূরে আরও দূরে, বর্গীরা পৌঁছোবার আগেই।


ree


জরুরী কথাগুলোঃ


  • বোলপুর ষ্টেশন থেকে বাইপাসে পৌঁছে, সেখান থেকে ইলামবাজার যাবার পথে পড়বে এই রায়পুর। নিজস্ব গাড়ি থাকলে গাড়িতে, অথবা টোটো ধরেও যাওয়া যেতে পারে এখানে।


  • দিনের আলোর মধ্যে যাওয়া এবং গিয়ে দিনের আলো থাকাকালীন ফিরে আসাই বাঞ্ছনীয়। দোতলায় উঠতে গেলে অথবা ঝোপঝাড় পেরিয়ে নামতে গেলে হোঁচট খাবার প্রবলসম্ভাবনা আছে, এছাড়া এদিক-সেদিক টুকটাক কাচ ছড়ানো আছে। তাই দেখে শুনে হাঁটাচলা করাই মঙ্গল।


  • ইদানীং রাজবাড়িতে ছবি তুলতে গেলে টাকাপয়সার গল্প তৈরি হয়েছে, স্থানীয় লোকজন যাকে বলেন “চাঁদা”। তাই প্রয়োজন হলে চাঁদা দিতে হতে পারে। চাঁদার মুল্য অবশ্য আমার জানা নেই।


  • শুটিং এর জন্যেও ভাড়া দেওয়া হয় এই বাড়ি। তাই স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে এই বাড়িকেন্দ্রিক উত্তেজনার অন্ত নেই।


  • রাজবাড়ির রাস্তায় ঢুকতে গেলে কচিকাচার দল নানান অজুহাতে দু’দশটাকা চাইতে পারে, না দিলে গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। এসব কথা জানিয়ে রাখলাম, যাতে আমার মত বিপাকে না পড়তে হয় ভরদুপুরে। অবশ্য এই চাঁদার গল্প শুধু রায়পুরে নয়, গোটা বোলপুর জুড়েই বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, চাঁদার অজুহাতে ছোট-বড়-মেজো নানানরকমের লোকজন এবং তাদের রয়েছে এই চাঁদাকেন্দ্রিক নানান বক্তব্য। তাই গাড়ি থাকুক অথবা স্থানীয় যানবাহন, হুটহাট করে টাকা না দিয়ে আগে কথা বলে, তারপর সামর্থ্য অনুযায়ী অনুদান দেওয়াই ভালো।


শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গেলে কাছাকাছির মধ্যে যদি পোড়োবাড়ির অ্যাডভেঞ্চার নিতে ইচ্ছে করে, তাহলে রায়পুরের জমিদারবাড়িই হয়ে উঠতে পারে আপনার রোমাঞ্চের সেরা ঠিকানা।


ree

 
 
 

6 комментариев


Padmini Patla
Padmini Patla
28 апр. 2021 г.

Congratulations for this completion of whole one year.. I feel each of the blog beside having the story, have it's own identity and the way you connect with that actually makes a difference. It's like seeing the history again in it's form and identify :)

Лайк
Shrabanti Mitra
Shrabanti Mitra
17 июл. 2021 г.
Ответ пользователю

Lovely expressions...Thanks a lot...Be with Pantho like this.😊

Лайк

koushik mitra
koushik mitra
28 апр. 2021 г.

😊অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই বর্ষপূর্তি তে। এরম কাজ এই ব্লগ ক্রমাগত যা করে চলে তা তুলনারহিত। এরম প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারার জগৎ আদিগন্ত হোক, 'পান্থ'জনের কাছে এই প্রত্যাশা রইল। যাত্রাপথের আনন্দগান যেন এভাবেই শুনে যেতে পাই।

Лайк
Shrabanti Mitra
Shrabanti Mitra
17 июл. 2021 г.
Ответ пользователю

দারুন বললেন...অনেক অনেক ধন্যবাদ...এভাবেই 'পান্থ'র সঙ্গে থাকুন।😊

Лайк

Atanu Biswas
Atanu Biswas
27 апр. 2021 г.

জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর শুভকামনা। ভ্রমণ ইতিহাস আর সাহিত্যর মেলবন্ধন কে চিত্রকথায় সাজিয়ে নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনেক অনেক অভিনন্দন।

Лайк
Shrabanti Mitra
Shrabanti Mitra
17 июл. 2021 г.
Ответ пользователю

অনেক অনেক ধন্যবাদ। এভাবেই 'পান্থ'র সঙ্গে থাকুন...😊

Лайк

© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page