top of page

লালমাটির গড়জঙ্গল আর ইছাই ঘোষের দেউল

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Mar 13, 2021
  • 3 min read


বাংলার বিবিধ স্থাপত্য গড়ে ওঠবার পিছনে কোন না কোন ইতিহাস সবসময়ই জুড়ে থাকে, আর সেসমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন, যে যে স্থাপত্য রুপে আমাদের চোখে প্রদর্শিত হয়, তার মাধ্যমে খানিকটা আন্দাজ করা যায়, তার গড়ে ওঠবার কাহিনী। এই কাহিনীগুলি কোথাও বিতর্কিত, কোথাও অস্পষ্ট, আবার কোথাও রোমাঞ্চকর রহস্যাবৃত। অনেক যুদ্ধ, অনেক রক্ত এবং খানিকটা কল্পনামিশ্রিত পটভূমিকাতেই বাংলার আরেক স্থাপত্য নিদর্শন গড়ে উঠেছিল পশ্চিম বর্ধমানের গভীর জঙ্গলে ঘেরা গৌরাঙ্গপুর গ্রামে, যার নাম- ইছাই ঘোষের দেউল।



এই দেউলের ইতিহাসের বিষয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ধর্মমঙ্গল কাব্যের কথা। এই কাব্যানুযায়ী, ঢেকুর গড়ের অধিপতি চণ্ডীর বরপুত্র অসীম শক্তিশালী সামন্তরাজ ইছাই ঘোষ বা ঈশ্বর ঘোষ বিদ্রোহী স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে গৌড়েশ্বরের নির্দেশে তাঁকে দমন করতে গিয়ে গৌড়েশ্বরের অধীনস্ত মেদিনীপুরের কোনো এক অঞ্চলের আরেক সামন্তরাজা কর্ণ সেন পরাজিত হন। বহু নিকটাত্মীয়ের প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির শোকে কাতর বৃদ্ধ কর্ণসেনের সঙ্গে গৌড়েশ্বর নিজের শ্যালিকা রঞ্জাবতীর বিয়ে দেন। এরপর বৃদ্ধ অপৌত্রক সামন্তরাজা কর্নসেন, তাঁর স্ত্রী রঞ্জাবতীর পুত্রলাভের আশায় ধর্মঠাকুরের কাছে ব্রত, পুজো ও কৃচ্ছ্সাধনের মাধ্যমে তাঁর কৃপায় তাঁরা পুত্রসন্তান লাভ করেন, যার নাম রাখা হয় লাউ সেন। পরবর্তীকালে এই লাউসেনের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন ‘ইছাই গোয়ালা’ বা ঈশ্বর ঘোষ।


ইছাই ঘোষ ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং বিদ্রোহী মানুষ। তিনি নিজের ক্ষমতায় বাউরি, মুচি, হাঁড়ি, বাগদি, ডোম শ্রেণীর মানুষজনকে নিয়ে সৈন্যদল তৈরি করেছিলেন এই অঞ্চলে। পরবর্তীকালে, এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে গড়ে তোলেন গোপভূমি বা ঢেকুরগড়। এই ‘ঢেকুরগড়’ নামটি জুড়েও রয়েছে ইতিহাস।



বৌদ্ধ তন্ত্রের ‘ডাকার্নব’ পুঁথি অনুসারে এই ঢেকুরগড়ের আগের নাম ছিল ঢেক্করী। সেটি পরিবর্তিত হয়ে হয় ত্রিষষ্ঠী গড়। এখানে সেসময় লোহার কারিগর ‘ঢেকারু’ সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করতেন। তাদের নামেই এলাকার নাম হয়ে ওঠে ‘ঢেকুর’ গড়। এখনো বর্ধমানের ওই অঞ্চলে কিছু ঢেকারু সম্প্রদায়ের মানুষজনের দেখা পাওয়া যায়।



আরেকটি মত অনুসারে, তান্ত্রিক ইছাই ঘোষের পুজোয় সেসময় অসংখ্য বলিদান হত, যার ফলস্বরূপ মন্দিরের পাশের নালা দিয়ে রক্তের ঢেউ বয়ে যেত। সেই রক্তের ঢেউয়ের সঙ্গে কেউ কেউ ঢেকুরগড় নামেরও সংযোগ ঘটিয়ে থাকেন।

ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষের লেখানুসারে, তৎকালীন রাঢ়বঙ্গের সামন্তরাজা ইছাই ঘোষ ছিল বর্ধমানের ঢেক্কুর গড় বা ঢেকুর গড়ের একচ্ছত্র আধিপতি। ইছাই ঘোষের মৃত্যুর পরে, পরবর্তী কোন গোপ রাজা, মধ্য অষ্টাদশ শতকে এই দেউলটি প্রতিষ্ঠা করেন মাতা ভগবতীর উদ্দেশ্যে(সম্ভবত)। অন্যান্য মত অনুসারে, বর্ধমানের রানী বিষ্ণুকুমারী এবং বর্ধমানের রাজা চিত্র সেনের উল্লেখ পাওয়া যায় এই দেউলের নির্মাণকারী হিসেবে।অনেক পুরাতাত্ত্বিকদের মতে এটি এগারোশ শতকে নির্মিত। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পর্যায়ে এই দেউলটির সংস্কার হয়েছে এবং তার ফলে নানান পরিবর্তন এসেছে দেউলে। নদীগর্ভ থেকে প্রায় ৩০–৩৫ ফুট উচ্চ এক ঢিপির উপরে দেউলটির নির্মাণ হয়েছিল। তবে তখন এর গর্ভে কোনো বেদী ছিলনা। ৬০–৭০ বছর আগে এটির সংস্করণের পর সিমেন্টের তৈরি এক শিবলিঙ্গ স্থাপন করা হয় এখানে। তারপর থেকেই এটি শিবের দেউল নামে লোকসমাজে পরিচিতি লাভ করে।



এই দেউল এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রক্ষিত। দেউলের উচ্চতা প্রায় আশি ফুট। অজয়নদ পশ্চিম থেকে উত্তর পূর্বে বাঁক নিয়েছে এখানে। দেউলের গায়ে যে সমস্ত টেরাকোটার কারুকার্য রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে রাঢ় বাংলার উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি। পোড়া মাটির কাজের মধ্যে নৃত্যরতা নর্তকী এবং কীর্তিমুখ মূর্তির রূপ দেখা যায়। শাল-শিরীষের বনের মাঝে, ইছাই ঘোষের স্মৃতি এভাবেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লাল মাটির দেশে।



ইছাই ঘোষের দেউল দেখবার পর বাঁ দিকের রাস্তায় ঘন জঙ্গল ধরে লাল মাটির ওপর দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ যাবার পর দেখা মিলবে গড়চন্ডী ধামের। যাবার পথে দু-পাশে শাল-শিরীষের সবুজ আলো, টিয়া, ফিঙে কিংবা বুলবুলির ডাক আর এবড়োখেবড়ো লাল মাটির তপ্ত ধুলোর গন্ধ মেখে চলতে চলতে কোন সময় হয়ত গোলকধাঁধা মনে হতে পারে এই পথ। হয়ত মনে হতে পারে কোন এক আদিম গুপ্তধনের সন্ধানে এগোচ্ছি, যার উৎস খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত একটা ধুকপুকুনি রয়েছে, যেটার অবসান যতক্ষণ না হচ্ছে, মনে হয় এগিয়ে যাই শেষ পর্যন্ত। এটাই আমাদের অতিপরিচিত গড়জঙ্গল।



ইছাইয়ের গড় বেড়ীর এলাকা আদতে একটি পৌরাণিক স্থল। এই গড়জঙ্গলের আদি গড়চন্ডী ধামের অভ্যন্তরেই রয়েছে ইছাইয়ের পূজিতা দেবী শ্যামারূপা মায়ের মন্দির।



মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরনির্মিত মুর্তির রূপ এখানে দুর্গা, যার উচ্চতা প্রায় দশ বারো ইঞ্চি। দুর্গা মন্ত্রেই তান্ত্রিক মতে পুজো হয় এখানে। মন্দিরপ্রাঙ্গণে রয়েছে একটি হাড়িকাঠ। লোকমুখে শোনা যায়, আগে এখানে কাপালিকেরা নরবলি দিতেন।



অজয় নদের ওপারে অবস্থিত কেন্দুলি গ্রাম থেকে ‘গীতগোবিন্দের’ রচয়িতা বৈষ্ণব কবি জয়দেব এসেছিলেন এই মন্দির দর্শন করতে। এই শ্যামরূপার গড়ের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে ইছাই ঘোষের রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে। শোনা যায় গড় জঙ্গলের কোনো এক অদৃশ্য স্থান থেকে কামানের আওয়াজ পেলে তবেই শুরু হয় এই মন্দিরে মহাষ্টমীর সন্ধিপুজো। এখনো ডোম সম্প্রদায়ের বহু মানুষ দূরদূরান্ত থেকে প্রতি বছর ১৩ই বৈশাখ এই অঞ্চলে আসেন তাঁদের স্বজাতি কালুবীরের পুজো করতে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময় অগুন্তি দর্শনার্থীর ভিড় হয় এই জঙ্গলে মায়ের পুজো দেখবার জন্য। তবে, গড়জঙ্গল পিকনিক স্পট হিসেবেও বেশ বিখ্যাত।




পথনির্দেশঃ

  • কলকাতা থেকে সড়কপথে গেলে দুর্গাপুর এসপ্রেসওয়ে ধরে পানাগড় হয়ে পৌঁছতে হবে দার্জিলিং মোড়। এবার মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে পৌঁছতে হবে এগারো মাইল। সেখান থেকে বাঁদিকের রাস্তায় গেলে প্রথমে পড়বে ইছাই ঘোষের দেউল। তারপর, সেখান থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ২-৩ কিলোমিটার গেলে দেখা যাবে মেধাশ্রম এবং শ্যামারূপা মায়ের মন্দির।

  • ট্রেনে যেতে চাইলে দুর্গাপুর পৌঁছে, সেখান থেকে বাস পাওয়া যায় গড়জঙ্গল বা দেউল যাবার।

  • বোলপুরে বেড়াতে এলে এগারো মাইল ধরে গড়জঙ্গল বা দেউল যাবার খুবই সহজ রাস্তা রয়েছে।

  • জঙ্গলের ভিতর মন্দির যেহেতু, তাই দিনের বেলার মধ্যে দর্শন সেরে ফিরে আসাই ভালো। তবে, রহস্য রোমাঞ্চের সাধ থাকলে রাতবিরেতেও হানা দেওয়া যেতে পারে।

  • মন্দিরে পুজো দেবার সামগ্রী বাইরে থেকে কিনে নিয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ, ভেতরে পুজো দেবার মত সেরকম কিছু পাওয়া যায়না।

  • দুর্গাপুজোর সময়ে যেহেতু স্থানীয় মানুষের খুব ভিড় হয়, তাই নিরিবিলিতে এখানে যেতে চাইলে শীতকালের দিকে প্ল্যান করাই ভালো।




 
 
 

2 Comments


Atanu Biswas
Atanu Biswas
Mar 14, 2021

ব্লগটি পড়তে পড়তে কখন যেন সময়ের হাত ধরে ইতিহাসের পাতায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। অজানাকে জানলাম আর অদেখাকে আপনার চোখ দিয়ে দেখলাম। ভালো লাগলো।

Like
Shrabanti Mitra
Shrabanti Mitra
Mar 16, 2021
Replying to

অনেক ধন্যবাদ, সঙ্গে থাকুন...🙂

Like

© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page