top of page

শুণ্ডির আরেকনাম হেতমপুর

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Feb 9, 2022
  • 5 min read



“গুপি গায়েন বাঘা বায়েন” দেখেননি এমন বাঙালির সংখ্যা খুবই কম। আর এই ছবি প্রথমবার দেখার পর, আমাদের অনেকেরই অনেক সময় হয়ত মনে হয়েছিল 'শুণ্ডি' এমনই এক জায়গা, যেখানে সাধারণ মানুষ পৌঁছতে পারেনা। কোন এক আদিম কালের আদিম রাজার বিশাল সাম্রাজ্যে ঘেরা, এ যেন এক ভিন্ন গ্রহের প্রদেশ।


অনেকবার ভেবেছি ছোট থেকে, কোথায় এই বিশাল প্রাসাদ? তারপর এদিক-সেদিক নানান রাজবাড়ির খোঁজ করতে করতে, একদিন জানতে পারলাম, এই 'শুণ্ডি' হল গিয়ে আসলে হেতমপুর, আর শুণ্ডির রাজার বাড়ি আসলে বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের হেতমপুর রাজবাড়ি।




হেতমপুরের রাজবাড়ি সেই ভিন্ন প্রদেশ, যাকে বোধহয় শুধু একটা রাজার বাড়ি বলা যায়না। এখনো অবধি যে যে রাজবাড়ি দেখেছি, সেখানে একটা মস্ত প্রাসাদ আর এই প্রাসাদের লাগোয়া চৌহদ্দির এদিকওদিক জায়গায় দু-চার বার হানা দিয়েই মন বেশ ভরে যেত। এমন করেই মনে মনে কোথাও একটা রাজবাড়িকেন্দ্রীক চেনা ছক তৈরি হয়ে গেছিলো, বলা ভালো একটা মাপঝোপ যাকে আন্দাজ করা যেতে পারে। কিন্তু আমার এই চেনা মানচিত্রের ছকটা প্রায় এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেল, হেতমপুরে এসে।



একটা দীর্ঘ সময়ের গভীর রক্তাক্ত ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই হেতমপুরে, যা শুরু হয়েছিল মোঘল আমলে। হেতমপুর অঞ্চলের নামকরণের পিছনে রাজরক্তের ভয়ঙ্কর ইতিহাস রয়েছে। 'হেতমপুর' নামটি উঠে আসে রাজনগরের খাঁ পরিবারের হেতম খাঁর নাম থেকেই।


হেতমপুর রাজবংশের বংশাবলী অনুযায়ী মুরলীধর চক্রবর্তী বাঁকুড়া থেকে ১৬৫০ সালে চাকরিসুত্রে প্রথম বীরভূমে আসেন রাজনগরের অধিপতি রণমন্ত খাঁর দরবারে। তাঁর বড় ছেলে চৈতন্যচরণ, বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের বাকি সকলকে নিয়ে চলে আসেন হেতমপুরে। প্রথমদিকে বেশ কিছু বছর দারিদ্র্যের সম্মুখীন হলেও, এরপর চৈতন্যচরণের বড় ছেলে রাধানাথ চক্রবর্তী, হেতমপুরের রায় পরিবারের আশ্রয়প্রাপ্ত হওয়ায় এবং জমিদারির সেরেস্তার কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করায়, কিছুদিনের মধ্যেই রাধানাথ পছন্দের ব্যক্তি হয়ে ওঠেন রায়পরিবারের কাছে এবং ধীরে ধীরে জমিজমা কিনতে কিনতে হেতমপুরেই নিজস্ব জমিদারি স্থাপন করতে উদ্যোগী হন।



পরবর্তীকালে রাধানাথ ও তাঁর ছেলে বিপ্রচরণ জমিদারির ভার বহন করায়, উত্তর উত্তর আয় বেড়ে যায় পরিবারের। এই সময় রাজনগরের অধিপতি তাঁকে “হুজুর" সম্মানে ভূষিত করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহে সরকারের পক্ষে থেকেও অনেক কাজ করেন এই পরিবারের লোকজন। বর্তমান রাজবাড়িটি ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিপ্রচরণের পৌত্র রামরঞ্জন চক্রবর্তী। সেখান থেকেই সম্ভবত এই বাড়িটি 'রঞ্জন প্যালেস' নামে পরিচিতি পায়। শোনা যায়, এই রাজবাড়িতে নাকি ১০০০টা দরজা আছে।


হেতমপুর রাজবাটী ডাভ পাবলিক স্কুল


গোটা রাজবাড়ি বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মূল বাড়ির পাশের অংশে গড়ে উঠেছে ডাভ পাবলিক স্কুল। বাড়ির ভেতরের দালান, বারান্দা, দরজা, জানলা সেভাবে যে আর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়না, তা বোঝাই যাচ্ছে। পরিবারের কর্মস্থল কলকাতায়, সেখানে নিজস্ব বাড়িও আছে। তবে এস্টেট রক্ষা করতে দু-একজনকে এখনো বাড়ি আগলে বসে থাকতে হয় এই হেতমপুরেই। এখনো প্রতিবছর জাঁকজমক সহকারে দুর্গাপুজো হয় এখানে। তার আগে অবশ্য ধুলো ঝেড়ে নতুন রঙে সাজাতেই হয় রাজবাড়িকে।


এ যে দৃশ্য দেখি অন্য!


গোটা বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল এ বাড়ির ছাদ। প্রাচীন আমলের উঁচু উঁচু সিঁড়ি, মোটা লোহার হাতল লাগানো পেল্লায় সাইজের দরজা... একটু একটু করে দেখছি আর চোখের সামনে ভাসছে গুগাবাবার সিনগুলো। তারপর, ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হবার পর দরজাটা যেই খুলল, অমনি একটা তীব্র আলোর ঝলকানি এসে পড়ল চোখের ওপর। সত্যিই! এ এক অন্য প্রদেশ...এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হচ্ছিল না, একবিংশ শতাব্দীতে কোনো এক রাজার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছিল, সেই দৃশ্যটা যখন শুণ্ডির রাজা ওপর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন, যুদ্ধ শেষের পর সমস্ত প্রজারা কিরকম আনন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে।



গোটা ছাদটায় ছবি তুলতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেয়েছি। ছাদের পাঁচিলের গায়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকাজগুলো, এখনো রাজপ্রতিকী বহন করছে যেন!

কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ হেতমপুর


এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে রাস্তাটা সোজা কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের দিকে বাঁক নিচ্ছে, এরপর সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এই কৃষ্ণচন্দ্র কলেজও হেতমপুর রাজপরিবারেরই অংশ, যার ইঙ্গিত কলেজের লাল বাড়ির মাথার ওপরের দু'পাশের দুই হাতির অবস্থান থেকেই বোঝা যায়। বিপ্রচরণ চক্রবর্তীর পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন ছোট হুজুর এই পরিবারের, তাঁর নামেই রাখা হয়েছে এই কলেজের নাম।


কলেজ ছাড়িয়ে কিছুটা এগোবার পর রাস্তার ডানদিকে দেখা মিলল ঐতিহাসিক চন্দ্রনাথ শিব মন্দিরের। মন্দিরের ফলক অনুযায়ী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৪৭ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন।




অপূর্ব টেরাকোটার কারুকাজ সম্বলিত এই মন্দিরের আকৃতি অন্যান্য মন্দিরের চেয়ে একেবারেই আলাদা, চাল বা রত্ন কোন শ্রেণীতেই একে ভাগ করা যায়না। বলা যেতে পারে, পোড়ামাটির সাথে নবরত্নের ধাঁচে তৈরী মন্দির এটি। ভেতরে রয়েছেন শ্বেত পাথরের মহাদেব, এখনো নিয়ম করে পূজার্চনা চলে এখানে।



চন্দ্রনাথ শিব মন্দিরের বৈচিত্রপূর্ণ টেরাকোটা প্যানেল



টেরাকোটার কারুকাজে দেশী ও বিদেশী উভয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিরই মিশ্র প্রভাব লক্ষণীয়



এরপর খানিকটা এগিয়ে গেলাম হেতমপুর বাজারের কাছে। সেখানে তখন মাছ-সব্জির ভিড়ে বাজার জমজমাট। উল্টোদিকে দেখলাম বেশ কয়েকটা শিব মন্দির, যেগুলি দেখে মনে হল সাম্প্রতিককালে এগুলির ওপর সিমেন্ট বসানো হয়েছে। তবে তার আগে মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কারুকাজ কিছু ছিল কিনা, তা বোঝবার উপায় নেই। পাশের রাস্তা দিয়ে এগোলাম আরও দুটি মন্দিরের হদিশে। রাস্তার ওপর দেখি শুঁড় তুলে দু'খানা হাতি দাঁড়িয়ে। এ যেন সেই প্রাচীন রাজত্বের নিশানা জারি রাখার প্রবল নস্টালজিয়ায় কৃত্রিম জারিজুরি দিয়ে সখ মেটানো আর মন ভোলানোর প্রচেষ্টা।


রাজার পাড়া


যাইহোক না কেন, মনকে এভাবেই শান্তনা দিয়ে এগিয়ে গেলাম কৃত্রিম হাতির অভ্যর্থনাকে স্বাগত জানাতে জানাতে। খানিকটা এগোবার পর দুটি প্রাচীন মন্দিরের দর্শন পাওয়া গেল একটা গলির মধ্যে। এখানে টেরাকোটার কারুকাজ এখনো বেশ স্পষ্ট। বিশেষত বলতে গেলে পোড়া মাটির কাজের মধ্যে উনিশ শতকের রানী ভিক্টোরিয়া, ইউরোপীয় নান এবং যাজকগণের প্রতিকৃতি দেখা যায় মন্দিরের গায়ে।



প্রত্যন্ত গ্রামের অন্দরে লুকিয়ে থাকা জ্বলজ্বলে ঐতিহাসিক কাহিনী



বর্তমানে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন যিনি, তাঁর মুখে শুনলাম গোটা হেতমপুরে এরকম অনেক প্রাচীন মন্দির ছড়িয়ে আছে, যেগুলির বেশ কিছু বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি এই দুটি মন্দিরও ভেঙ্গে ফেলবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রাজপরিবারের একাংশের প্রচেষ্টায় টিকিয়ে রাখা গেছে এখনো। তবে, কোনরকম সাহায্য ছাড়া এই মন্দিরগুলি যে আর বেশীদিন টিকিয়ে রাখা যাবেনা, সে কথাও জানান তিনি।



কড়িকাঠের দুর্গাদালান


এরপর হাঁটতে হাঁটতে হদিশ মিলল একটি দুর্গাদালানের। এটিও রাজ পরিবারেরই আরেক শরিকের অংশ এবং এখানেও দুর্গাপুজো হয়। এই দালানের চালটি পুরোটাই কাঠের তৈরি। এখন অবশ্য এর ওপর টিনের চাল তৈরি হলেও, এর তলায় যে কালো পুরু কাঠটি সাজানো রয়েছে, তা নির্দ্বিধায় ঐতিহ্যের স্মারক বহন করে চলেছে এখনো।



এরপর চলতে চলতে রাজবাড়ির আরেকটি অন্য অংশে ঢুকে পড়লাম। রাস্তার ওপর উঁচু পাঁচিল, ওপরে লোহার শিক বসানো জানলা, নীচের অংশ সামনে থেকে দেখলে মনে হয় একটি অর্ধগোলাকৃতিকার প্রবেশপথ। এটি পরবর্তীতে হেতমপুর রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। দেওয়ালের ফলক অনুযায়ী এটিকে বিদ্যালয় রূপে স্থাপন করা হয়েছে ১৮৬৯ সালে। একদম ওপরে যে ত্রিভুজাকৃতির চূড়াটি রয়েছে, তার দু'পাশে দুই ঘোড়ার মাঝখানের গোল ফলক থেকে জানা যায় এই স্কুলের স্থাপক রাজা বাহাদুর রামরঞ্জন চক্রবর্তী।


রাজার পাড়ার ইশকুল


আজ এই রাজপরিবারে ঐতিহাসিক ঝড়ের ইতি ঘটলেও, পরিবার ভেঙে গেছে কলুষিত সময়ের অবহেলায়। রাজবাড়ি এখন দুটি অংশে বিভক্ত, নিতান্ত রাজনৈতিক কারণেই। যার একটা বৃহৎ অংশ জনসমক্ষে পরিদর্শিত হলেও, আরেকটা অংশ চাবি বন্ধ থাকে বেশীরভাগ সময়েই। সেসব তালা-চাবির দায়ভার, সাথে তালাচাবি হস্তক্ষেপের লড়াই আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনো ভীষণ ভাবে চলে গোটা হেতমপুর জুড়ে। আর তাই এখন সেভাবে শুটিংয়ের জন্য অনুমতিও মেলেনা এই বাড়িতে।



গোটা হেতমপুর রাজবাড়ি ঘুরে দেখতে গেলে একটা গোটা দিনও যথেষ্ট নয় বলে আমার মনে হয়েছে। সময়ের অভাবে তৃষ্ণার্ত চাউনিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে আমায় মাঝপথে, আবার ফিরে যাবার আশায়। তবে, ফিরে যেতে যেতে মনে হয়েছে, হেতমপুর রাজবাড়ি এবং রাজবংশের এই বিশাল সাম্রাজ্যের অনেকটাই এখনো ভগ্নপ্রায় অবস্থাতেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর পাঁচটি রাজবাড়ির সঙ্গে এর স্থাপত্যশৈলীর যে পার্থক্য, তা চাক্ষুষ না দেখলে আন্দাজ করা যাবেনা। আমার মনে হয়, কোন ছবিই যথেষ্ট নয় এই বাড়ির স্থাপত্যরূপকে সম্পূর্ণ ভাবে তুলে ধরবার জন্য। গ্রামের মানুষের সচেতনতা এবং স্থানীয় সরকারি সংস্থার যৌথ সাহায্য ছাড়া এই বিশাল প্রাসাদ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা কখনোই। কালের নিয়মে আর সামাজিক অবহেলায়, তা একদিন ধ্বংসীভূত হবেই একটু একটু করে। তারপর আমরা, এমনই কোনো এক প্রাচীন হেরিটেজের নিদর্শনকে চোখের সামনে হারিয়ে যেতে দেখে হা-হুতাশ করা শুরু করব আবার।



জরুরী কথাগুলোঃ


● হেতমপুর রাজবাড়ি যেতে হলে দুবরাজপুর সংলগ্ন অঞ্চলের কাছাকাছি কয়েকটা বেড়াবার জায়গা বাছাই করে রাখা ভালো আগে থেকে। সবথেকে নিকটবর্তী যে জায়গাটি পড়বে হেতমপুর রাজবাড়ি থেকে, সেটি হল মামা-ভাগ্নে পাহাড়। এছাড়াও আরও কয়েকটি জায়গা রয়েছে। আর যদি একদিনের হিসেবে প্ল্যান করা হ্য়, তাহলে গাড়ি নিয়ে যাওয়াটাই সবথেকে শ্রেয়।


● হেতমপুর রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো ছাড়া যাবার সেরকম অনুমতি নেই। আর এমনিতেও এখন সব শরিকি ভাগবাটোয়ারার চক্করে বেশ কিছু জায়গা সাধারণের প্রবেশের জন্য অনুমতিও মেলেনা। তবে মূল বাড়ির কিছু জায়গা দেখতে দেওয়া হয়।



 
 
 

Комментарии


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page