top of page

সাতমহলার স্বপ্নপুরী- কালিকাপুর

  • Writer: Shrabanti Mitra
    Shrabanti Mitra
  • Dec 6, 2021
  • 4 min read

Updated: Dec 10, 2021


ree


স্মৃতি সততই সুখের। আমাদের গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে যেসব বিশাল জমিদারবাড়ি আলোআঁধারি জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে আছে, তার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে কতই না সুখ-দুঃখের গল্প সামনে এসে হাজির হয়। এসবের কোনটা মনে হয় বাস্তবিক, আবার কোনটা সিনেম্যাটিক। কিন্তু যখন সিনেমাই বাস্তবের স্মৃতির মধ্যে ঢুকে পড়ে, সেইসব দিনগুলোকে সম্বল করে ঘুরে বেড়ায় সাতমহলার আনাচে-কানাচে? তখন কেমন অদ্ভুত শুনতে লাগে, তাই না? এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা কি কখনো ভেবেছিলেন, যে এই বিশাল প্রাসাদ একদিন শুধুমাত্র সিনেমার লোকেশান হিসেবে টিকে থাকবে!


ree


‘খন্ডহর’, ‘নৌকাডুবি’, ‘গয়নার বাক্স’, ‘এলার চার অধ্যায়’, ‘মেঘনাদবধ রহস্য’, ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’… ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি... এ লিস্টি শেষ হবার নয়। বরং বাড়তে থাকছে উত্তরোত্তর। অনেকগুলো দিন ধরে চলা এক-একটা ছবির শুটিং। আর এই প্রতিটা ছবি মানেই একগুচ্ছ স্মৃতি, যা সহজে মন থেকে মুছে ফেলা যায়না, যায়নি। প্রতিবারই একটা চাপা রাগ আর অভিমান কাজ করেছে লোকেশান হিসেবে বাড়িখানা অন্য একটা বাইরের ইউনিটের কাছে ভাড়া দিতে। আবার, প্রতিবারই শুটিং এর শেষ দিনে মায়া পড়ে গেছে ওই বাইরের লোকগুলোর প্রতি। চায়ের ভাঁড়, আধখাওয়া সিগারেটের টুকরো আবার সব ঝাঁট দিয়ে জল ঢেলে পরিষ্কার করতে হয়েছে। কত গঞ্জনা, কত অপমান, তারপরেও দিনের শেষে যে টাকাটা এসেছে, তা দিয়ে আড়ম্বর না হোক, দুবেলার জীবনধারণে চলে গেছে মানুষগুলোর। এখান থেকে যে টাকাটা সিন্দুকে গুনে গুনে তুলে রাখা হয়েছে, তা দিয়ে প্রতি বছর নিয়ম করে দুর্গাপুজোটা ঠিক হয়ে আসছে এখনো।


ree

ঠিক বোলপুর নয়, জেলা অনুযায়ী পূর্ব বর্ধমান, তবে বোলপুরে বেড়াতে এলে সহজে যাওয়া যায় কালিকাপুর। এক্কেবারে লাল মাটির রাস্তা ধরে সিধে ঢুকে যাওয়া, কোথাও কিচ্ছু নেই কুঁড়ে ঘর, সবুজ জমি আর ধানের গোলা ছাড়া। তারপর রাস্তার ডানদিকে দুটো টেরাকোটার মন্দির দেখে থমকে যাওয়া, হ্যাঁ ওটাই কালিকাপুর রাজবাড়ি। সঠিক ভাবে পারমিশান না নিলে ভেতরে ঢোকাটা শক্ত, কারণ ওটা তো সিনেমার হটস্পট।


ree

বাকি জমিদারবাড়ির সাথে কালিকাপুরের তফাৎ বিস্তর। বাড়ির ভেতর সাধারণত এত বড় বড় মহল দেখতে পাওয়া যায়না সচরাচর। এখানে যে পেল্লায় একেকটা মহল তৈরি হয়েছিল, তার বেশীরভাগই আগের অবস্থায় নেই তেমন, তাই এখন এখানে গেলে কতটা অংশ জুড়ে এই জমিদারি গড়ে উঠেছিল, তা বোঝা খানিকটা কঠিন হয়ে পড়ে। এই সবকটি অংশের মধ্যে সবচেয়ে যে জায়গাটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল, ঠাকুরদালা্নের আটচালা।


ree

এক একটা ছাদবিহীন চাল যেন, ইতিহাসের এক একটা রক্তাক্ত মুহূর্তের ভার বহন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির মূল প্রাঙ্গনে। এখনো এর যে কোন একটা পিলারে কান পাতলে কখনো হয়ত শোনা যেতে পারে ঢাকের আওয়াজ, কখনো জলসাঘরের উল্লাসময় কলরোল আবার কখনো আকশান আর কাট বলার ছেঁড়া ছেঁড়া আর্তনাদ।


ree

যতটুকু গোড়ার দিকের খবর জোগাড় করা গেল, তা থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে বর্ধমান রাজার দেওয়ান পরমানন্দ রায়, ইজারা মারফৎ এই কালিকাপুর অঞ্চলে বিরাট জঙ্গলের অধিকার পান। আর সেখানেই জঙ্গল কেটে প্রথমে বানানো হয় বসতবাড়ি, তারপর আউশগ্রামের একটা বড় অংশের জমিদারি পাবার পর ধীরেধীরে তৈরি হয় এই সাতমহলা প্রাসাদ, যার একদিকে রয়েছে মস্ত পুকুর, বাগান, আর অন্যদিকে মন্দির সমেত বিশাল আটচালা দুর্গাদালান। শোনা যায়, সাতজন ভাইয়ের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা প্রাসাদ আর মহল বনানোর পর থেকে এই বাড়ির নাম “সাতমহলা” বাড়ি হয়ে ওঠে।


ree

মূল প্রবেশদ্বার


এই রায় পরিবারের আদি বসবাস ছিল অজয় নদের তীরে মৌক্ষীরা গ্রামে। যেহেতু প্রবল বর্ষার প্রকোপে অজয় নদের সংলগ্ন অঞ্চল বন্যায় প্রাবিত হত, তাই রায় পরিবারের লোকজন কালিকাপুরে চলে আসেন, আর তারপরেই প্রাপ্ত জমিদারির সুত্রে ১৮১৯ সালে গড়ে এই “সাতমহলা রাজবাড়ি”।


ree

কালিকাপুরের এই বাড়ি ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলে দেখা যাবে ইতিহাস আরও কিছুটা ঘনীভূত হয়ে রহস্য তৈরি করেছে সেখানে। জঙ্গল আর আগাছার ফাঁক দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগোলে পরে দেখতে পাওয়া যাবে একটা ভগ্নপ্রায় বাড়ি, যাকে স্থানীয় মানুষেরা বলেন “নীলকুঠী”। আগে নাকি এর আশেপাশের জমিতে নীলের চাষ হত।


ree

ভগ্নপ্রায় নীলকুঠী


এই বাড়িটা পেরিয়ে আরও কয়েক পা হাঁটলে একটা বেশ বড় আকারের পুকুর দেখা যাবে, যেটিই আগে দীঘি ছিল। এটি যে জমিদার বাড়ি তৈরি হবার সময়ে বানানো হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই কারণ, ঘাটের পার্শ্ববর্তী অংশ ও শান বাঁধানো মেঝের ওপর যে সুক্ষ কারুকাজ এখনো খানিকটা হলেও বর্তমান রয়েছে, সেই জ্যামিতিক নকশাই এই ঘাটের উৎস সন্ধানে সাহায্য করে। জানিনা, এই জ্যামিতিক চিহ্নিতকরণর কোন সাঙ্কেতিক বৈশিষ্ট্য ছিল কিনা আদতে!


ree

মুল বাড়ি লাগোয়া দুই প্রাচীন টেরাকোটা মন্দির


জমিদারবাড়ির বাইরের দু’টি টেরাকোটার শিব মন্দিরে এখনো নিত্যপুজো হয়। মন্দিরের ফলক থেকে জানা যায়, এই মন্দিরদু’টির স্থাপনকাল ১৭৬১ সাল। দুটি মন্দিরেই এখনো পৌরাণিক স্থাপত্যরূপ জ্বলজ্বল করছে।


ree

পৌরাণিক দৃশ্যাবলীর বিবিধ রূপ


ree

১৭৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের ফলকনামা


ree

এই দুটি মন্দির ছাড়াও গোটা গ্রামে আরও কয়েকটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, সেগুলো আরও প্রাচীন এবং ভগ্নপ্রায়। এছাড়াও এই পথ ধরে বেশ খানিকটা এগোবার পর আমি আরও একটা পুরনো বাড়ির সন্ধান পেয়েছিলাম, যদিও তার ভেতরে ঢোকা যায়নি এবং বিশেষ তথ্যাদি পাওয়া যায়নি সে বিষয়ে।


ree

জমিদারবাড়ি সংলগ্ন এই দুই মন্দিরের, টেরাকোটার কারুকাজ সম্বলিত বেশীরভাগ প্যানেলই দৃশ্যত অক্ষত রয়েছে এখনো

ree


সিনেমার ফ্রেম দেখে যে বাড়ির প্রতি ভালবাসা জন্মায়, তাকে চাক্ষুষ দেখলে শুধু ইতিহাস নয়, সিনেমার সিনও মনে পরে, যেসব সিনগুলো মনের কোণার কুলুঙ্গিতে সযত্নে তোলা আছে। সাতমহলার সাতরঙের গল্পে সেসব চরিত্রেরাও হেঁটে বেড়ায় দালানজুড়ে। শুধু একবার “কাট” বলার অপেক্ষা… চাঁদের আলোয় ছবিরা কখন ছায়া হয়ে যায়, জানতি পারা যায়না!


ree

ছায়াপথ


পথ নির্দেশনাঃ কালিকাপুর জমিদারবাড়ি যেতে হলে নিজস্ব গাড়ি না থাকলে যাওয়া এবং সব দেখে শুনে ফিরে আসা, বেশ মুশকিল। পানাগড়–মোড়গ্রাম সড়কে ইলামবাজার যাওয়ার পথে ১১ মাইল বাসস্টপ থেকে ডানদিকে যে রাস্তাটা গুসকরার দিকে চলে গিয়েছে, সেই রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে বাঁ দিকে লাল মাটির রাস্তা ধরে একটা প্রাইমারি স্কুল পেরোলেই কালিকাপুর। এই বাড়ি থেকে খানিকটা এগোলে দীঘির ঘাটে যাওয়া যায়। তবে সঠিক ভাবে অনুমতি না নিয়ে গেলে, অসুবিধা হতে পারে। সাধারণ মানুষের জন্য মূল দু-একটি বাড়ি ছাড়া, বাকি বাড়িগুলোয় প্রবেশ করা যায়না সেভাবে। তবে, দুর্গাপুজোর সময় প্রবেশ অবারিত সকলের জন্যই।


ree

 
 
 

Comments


© 2023 by NOMAD ON THE ROAD. Proudly created with Wix.com

  • Facebook
  • Instagram
bottom of page